ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাব বাঁধ ঝুঁকিতে, বিদ্যুৎহীন অনেকে

জোয়ারের পানি ঢুকতে শুরু করেছে ঢাকী নদীতে। একটু একটু করে ফেঁপে উঠছে নদী। তীরে ভেঙে যাওয়া বাঁধ আটকাতে আসা কয়েক শ মানুষ কাজের গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। দ্রুত শেষ করতে হবে কাজ। দিনের (বুধবার) মধ্যে যে করেই হোক বাঁধের কাজ শেষ করতে হবে, আটকাতে হবে নোনাজল।

খুলনার দাকোপ উপজেলার বটবুনিয়া বাজারসংলগ্ন সরদারবাড়ি এলাকায় ভেঙে যাওয়া একটি বাঁধ মেরামতের দৃশ্য এটি। গতকাল বুধবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, অদূরে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন মধ্যবয়সী এক নারী; নাম তাঁর সুনীতা সরদার। বাঁধ ভেঙে তাঁর ঘরবাড়ি, বসতভিটা সবই গেছে। অসহায় কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘সব তো গেল। এখন জল ঢোকাডা যদি বন্ধ হয়।’

ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে দক্ষিণ উপকূলের কমপক্ষে সাত জেলায় বেড়িবাঁধ আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খুলনায় স্থানীয় লোকজন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বাঁধ মেরামতের কাজ করছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডও (পাউবো) অনেক স্থানে বাঁধ সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে।

গত রোববার রাতে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর থেকে উপকূলীয় অনেক উপজেলা এখনো বিদ্যুৎহীন। বিদ্যুতের লাইনের ওপর ভেঙে পড়া গাছ অপসারণ ও বিদ্যুতের ছেঁড়া তার মেরামত করে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

চলছে বাঁধ মেরামত

রিমালের প্রভাবে উচ্চ জোয়ারে খুলনা জেলার ২৩টি স্থান দিয়ে বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। আর ৩২টি স্থানে দেড় কিলোমিটারের কিছু বেশি বাঁধ ভেঙে গেছে। মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। শুধু পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের ২২ নম্বর পোল্ডার ছাড়া আর সব জায়গায় বাঁধ মেরামত করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন খুলনা পাউবোর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা।

বরিশালে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০৬ মিটার বাঁধ, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ৫৩০ মিটার। জোয়ারে পানি উঠছে। জরুরি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ শুরু হয়েছে।

পটুয়াখালীতে বাঁধ ভেঙেছে সাড়ে ১২ কিলোমিটার। অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার পরই বাঁধ মেরামত শুরু হবে। তবে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশে জিও ব্যাগ ফেলে রক্ষার কাজ শুরু হয়েছে।

পিরোজপুরে বেড়িবাঁধে ১ হাজার ১৮৫ মিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাঙা বাঁধ দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পাউবো পিরোজপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী নুসাইর হোসেন বলেন, পানি বাঁধের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় কিছু বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সাতক্ষীরা পাউবোর বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন জানিয়েছেন, তাঁদের আওতাধীন ৩৮০ কিলোমিটার বাঁধের ১০ কিলোমিটারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনিরুল ইসলাম জানান, তাঁর আওতায় ৩৯৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ১২ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বাগেরহাটে পাউবোর ১২ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বরগুনায় ২০টি পয়েন্টে প্রায় তিন কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে বিলীন হয়ে গেছে। এসব ভাঙা স্থান মেরামতের কাজ শুরু করেছে পাউবো।

অনেক স্থানে বিদ্যুৎ নেই

‌ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ঝালকাঠি শহরসহ চার উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রায় ৬০ ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে। এতে পৌর শহর ও আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা পানির সংকটে পড়েছেন। বিদ্যুতের অভাবে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। জেলা শহরের বাসিন্দারা রান্নাবান্না ও গৃহস্থালির কাজে পৌর কর্তৃপক্ষের সরবরাহ করা পানির ওপর নির্ভরশীল। তবে বিদ্যুৎ না থাকায় প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছেন না বাসিন্দারা।

ঝালকাঠি শহরের ডাক্তারপট্টি এলাকার গৃহবধূ ছবি আক্তার বলেন, ‘আমরা প্রায় চার দিন ধরে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় আছি। রান্নাবান্না ও গৃহস্থালি কাজে পৌরসভার পানি সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। তাই বিদ্যুৎ না থাকায় আমরা ভোগান্তিতে পড়েছি।’

গতকাল সকালে রাজাপুর উপজেলা সদরের কিছু অংশে পল্লী বিদ্যুৎ বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়েছে। এ ছাড়া জেলার অধিকাংশ এলাকা বিদ্যুৎবিহীন রয়েছে। এর আগে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে গত রোববার রাত ১১টার দিকে জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এতে বিপাকে পড়েন বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো) ও পল্লী বিদ্যুতের প্রায় দেড় লাখ গ্রাহক। ঝালকাঠি পৌরসভা, কাঁঠালিয়া ও নলছিটি উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ওজোপাডিকো এবং বাকি এলাকা পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন।

ঝালকাঠি ওজোপাডিকোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান বলেন, ঝালকাঠি-বরিশাল আঞ্চলিক মহাসড়কসহ বিভিন্ন এলাকায় ১১টি স্থানে ৩৩ হাজার কেভি লাইনের ওপর গাছ পড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়েছে। এ ছাড়া রিমালের তাণ্ডবে বিভিন্ন এলাকায় গাছ ও গাছের ডালপালা ভেঙে বিদ্যুতের লাইন ও খুঁটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এগুলোর মেরামতে কাজ চলছে।

বরিশাল জেলাতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ এখনো পুরোপুরি স্বাভাবাক হয়নি। জেলার দুটি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় ৭ লাখ ৮০ হাজার গ্রাহক রয়েছে। পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তাদের দাবি, এর মধ্যে ২ লাখ ২৫ হাজার বাদে অন্য গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পেরেছেন তাঁরা।

পটুয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিদ্যুৎ গ্রাহক ৬ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে ৩ লাখ ৭০ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ পেয়েছেন। বাকি ৩ লাখ গ্রাহক এখনো বিদ্যুৎবিহীন।

ভোলার বিদ্যুৎ সরবরাহও স্বাভাবিক হয়নি। সংযোগ লাইনে ত্রুটি থাকার কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। ভোলার ওজোপাডিকো ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বিদ্যুৎ বিতরণ করে বোরহানউদ্দিন থেকে আসা পিডিবির ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে। এ বিদ্যুৎ আসে ৩৩ কেভি লাইন দিয়ে। এ লাইনে ত্রুটি দেখা দিয়েছে।

এ ছাড়া সাতক্ষীরা, পিরোজপুর ও বাগেরহাটে এখনো বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।

সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত

পটুয়াখালী-শাখারিয়া-গলাচিপা সড়কে সরাসরি যাত্রীবাহী বাসসহ যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ৩৪ কিলোমিটার এই সড়কের গলাচিপার আমখোলা ও গোলখালী ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী সুহুরি এলাকার জলকপাট–সংলগ্ন সড়ক জোয়ারের জলোচ্ছ্বাসে ধসে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। তবে সড়কের ভেঙে যাওয়া অংশের দুই পাড়ে বাস বদল করে যাত্রীরা পটুয়াখালী-গলাচিপা সড়কে যাতায়াত করছেন।

পাউবো পটুয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সড়কটি সচল করতে পাউবো ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। মাটি দিয়ে বাঁধের ভেঙে যাওয়া স্থান ভরাট করা হচ্ছে।

বাগেরহাটে আঞ্চলিক সড়কগুলোতে যোগাযোগব্যবস্থা স্বাভাবিক আছে। তবে বিভিন্ন এলাকায় এলজিইডির অনেক ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক এখনো যোগাযোগ উপযোগী হয়নি।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।