ভেসে উঠছে রিমালের ক্ষতচিহ্ন রুনু-আলাউদ্দিনরা নিঃস্ব, চোখের জলেই আকুতি!

সাজানো সংসার ছিল রুনু-আলাউদ্দিন দম্পতির। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে নিঃস্ব। চোখের সামনে মুহূর্তেই মাথা গোঁজার ঘরটি ভেসে গেছে। আছে শুধু ভিটেমাটি। স্বামী-স্ত্রী নির্বাক বসে আছেন খালি ভিটাতেই।

দুই শিশু আর শ্বশুরকে নিয়ে মানবেতর দিন কাটছে তাদের। রান্নাবান্না করার অবস্থা নেই। প্রতিবেশীদের দয়ায় চলছে দিন। একেকদিন একেক বাড়িতে রাতযাপন। পেশায়  জেলে আলাউদ্দিনের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানোও এখন অসম্ভব প্রায়। রুনুর সঙ্গে প্রতিবেদক কথা বলতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন।

বলেন, ভাইরে, আমাগো যে কিছুই নাই। এই বইন্যায় (ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস) আমাগো সব নিয়া গ্যাছে (গেছে)। জীবনডা লইয়া বাইচা আছি। ঘর ওঠানোর সামর্থ্যও নাই।

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দুর্গম চরমোন্তাজ ইউনিয়নের নয়ারচরে রুনু-আলাউদ্দিন দম্পতির এমন দুর্দশা চোখে পড়েছে।

বিধবা সুফিয়া বেগমের (৮০) ঘর গেছে জলোচ্ছ্বাসে। এখন বেড়িবাঁধের ওপর পলিথিনের ছাপড়া দিয়ে বসবাস করছেন তিনি। সঙ্গে আরেকটি পলিথিনের ছাপড়া দিয়ে বাস করছেন তার ছেলে-পুত্রবধূ আর নাতি-নাতনি।

সুফিয়া বলেন, কোনোরকম পলিথিন দিয়া মুড়া (ছাউনি) দিয়া থাহি (থাকি) বাবা। রানতে বাড়তে পারি না। হাড়ি-পাতিল সব নিয়া গেছে। চুলা নাইও।

বৃদ্ধ শাহিনুর-বাবুল দম্পতির ঘরটিও বিধ্বস্ত হয়েছে রিমালে। ২ ছেলে, ২ মেয়ে, নাতি, পুত্রবধূসহ ৮ জনের সংসার। ঝড়ের পর থেকে খেয়ে, না খেয়ে কাটছে দিন।

বৃহস্পতিবার দুপুরে শাহিনুর চাল ভেজে দিয়েছেন সবার জন্য। চালভাজা খেয়েই ঘর ঠিক করার চেষ্টা করছেন পরিবারের সবাই।

জেলে শাহজালাল মাঝির মা, স্ত্রী, ৬ সন্তানসহ ৯ সদস্যের সংসার। ঘরে রান্নাবান্নার মতো অবস্থা নেই। বৃহস্পতিবার দুপুরে ছেলে-মেয়েদের ‘পানিতাল’ কেটে খেতে দিয়েছেন। ছেলে-মেয়েরা পানিতাল খেয়েই ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করছেন।
কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন শাহজালাল। বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে আমাগো সব নিয়া গেছে। প্রধামন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন-আমাদেরকে তিনি যেন থাকার মতো একটা মাথাগোঁজার ঠাঁই করে দেন। আমার মতো অনেকে আছেন, তাদের জন্যও তিনি যেন একটা ব্যবস্থা করেন।

শুধু রুনু-আলাউদ্দিন, শাহিনুর-বাবুল কিংবা সুফিয়া, শাহজালালই নয়-নয়ারচর গ্রামের কমবেশি অনেকেরই এমন দুর্বিষহ অবস্থা। বঙ্গোপসাগর তীরের এ গ্রামে রীতিমতো ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গেছে রিমাল।

শুধু নয়ারচর নয়-চরমোন্তাজ ইউনিয়নের চরআন্ডা, বউ বাজার, দক্ষিণ চরমোন্তাজ এবং চালিতাবুনিয়া ইউনিয়নসহ উপজেলার প্রায় চরাঞ্চলে কমবেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কারও বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে, কারও একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

প্রশাসনের তথ্যমতে, রাঙ্গাবালী উপজেলায় সাড়ে ৮ হাজার ঘরবাড়ি ও প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে দেড় হাজারেরও বেশি পুকুর, ঘেরের মাছ। ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। মারা গেছে ৫৭৭টি গবাদিপশু। সবমিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৪৮ হাজার ৩০০। মোট ক্ষতির পরিমাণ ১১৫ কোটি ৯০ লাখ ৫৭ হাজার ৪শ টাকা।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান অজিত কুমার দেবনাথ বলেন, ইতোমধ্যে দেড় হাজার প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। ৩২০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধ মেরামত ও দুর্গতদের সহায়তার জন্য ধাপে ধাপে ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে আসায় ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন বুনছেন দুর্গতরা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান শুক্রবার রাঙ্গাবালী উপজেলার দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন।

দুর্গত এলাকা পরিদর্শনকালে পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) আসনের সংসদ-সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান বলেন, কোনো মানুষ কষ্টে থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী এসব মানুষের পাশে আছেন। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।

Check Also

সন্ধ্যায় আবারো সড়ক অবরোধ তিতুমীর শিক্ষার্থীদের

রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপান্তরে কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ না করায় আবারো সড়ক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।