অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। মানুষের আয় কমছে; কিন্তু বাড়ছে খাবারসহ অধিকাংশ পণ্যের দাম। এতে বেশি কষ্ট পাচ্ছে গরিব ও সাধারণ মানুষ।
বর্তমানে দেশের মূল্যস্ফীতি ৯ ও ১০ শতাংশে পৌঁছেছে। এটি শ্রীলংকার চেয়েও বেশি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা সরকারের বড় ব্যর্থতা। বেড়েছে ধনী ও গরিবের বৈষম্য। সরকার নিত্যপণ্যের শুল্ক কমালেও এর সুফল পাচ্ছেন এক ধরনের ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় আগামী বাজেটে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা। সরকারের অতিরিক্ত ঋণের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
রোববার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলা হয়। সংবাদ সম্মেলনের বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৩-২৪ : তৃতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা’। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
এ সময় তিনি বলেন, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হলেও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারছে না। এছাড়াও উচ্চসুদে বৈদেশিক ঋণ রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৯ ও ১০ শতাংশে। এটি শ্রীলংকার চেয়েও বেশি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা সরকারের জন্য বড় ধরনের ব্যর্থতা। তিনি বলেন, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ, মিনিকেট ১৭ ভাগ এবং পাইজামের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ গরিব ও মধ্যবিত্তদের পণ্যে মুনাফাখোররা বেশি লাভ করছে।
এছাড়াও বাজারে মুসর ডাল ৯৫, আটা ৪০-৫৪, ময়দা ৬০, খোলা সয়াবিন ৮৪, বোতলজাত সয়াবিন ৫৬ এবং পামওয়েলে ১০৬ ভাগ দাম বেড়েছে। গরুর মাংসের দামও বেশি, ব্রয়লার মুরগি ৬০, চিনি ১৫২, গুঁড়া দুধ ৪৬-৮০, পেঁয়াজ ১৬৪, রসুন ৩১০ এবং শুকনা মরিচ ১০৫ ভাগ বেড়েছে; যা আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক বেশি। বাজার নজরদারি ব্যবস্থায় দুর্বলতা দেখতে পাচ্ছি।
তিনি বলেন, নিম্ন-আয়ের দেশ হয়েও বিলাসী দেশে পরিণত হয়েছি। মানুষের আয় কম; কিন্তু খাবারে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হয়। যার ভুক্তভোগী গরিব ও সাধারণ মানুষ। আমরা কোন অর্থনীতির দেশে রয়েছি? সরকারের প্রচেষ্টা রয়েছে। অনেক সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক ট্যারিফ কমিয়ে দেওয়া হয়, এর সুফল তোলেন একধরনের ব্যবসায়ীরা। ধনী ও গরিবের বৈষম্য বেড়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে মাথাপিছু অভ্যন্তরীণ আয় ২ হাজার ৬৭৫ মার্কিন ডলার, আর মাথাপিছু জাতীয় আয় ২ হাজার ৭৮৪ ডলার। মাথাপিছু গড় আয় যতটুকু পেয়েছি, মূলত উচ্চ আয় করেন তাদের কারণে। গরিব মানুষের কথা বিবেচনা করলে তাদের আয় কমেছে। এখানে বৈষম্য বেড়েছে। তাদের উন্নতি হয়নি। বেসরকারি বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে না। সরকারের অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া একটি বড় কারণ। বিষয়টি সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারের ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না।
তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। কিন্তু জানুয়ারিতে তা সংশোধন করে সাড়ে ৬ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তা আরও কম প্রাক্কলন করেছে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে রয়েছে সরকার। জিডিপি বৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের ধারাটি বাড়ছে না। বরং কমছে। জিডিপিতে জাতীয় আয় বাড়ছে; কিন্তু কর্মসংস্থানের ভূমিকা রাখতে পারছে না বা কম সহায়তা করছে। যতটুকু কর্মসংস্থান হচ্ছে, তা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে বাড়ছে; যা আসলে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, ওই কর্মসংস্থানে মজুরি ও নিরাপত্তার হুমকি রয়েছে।
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রসঙ্গে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রাজস্ব আদায়ের ১৩ শতাংশ হয়েছে; যা গত বছরের জুলাই-জানুয়ারি হিসাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে। গত বছর নেতিবাচক ছিল। সেখান থেকে ইতিবাচক ধারায় ফিলে এসেছি, সেটা ভালো দিক। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বাকি সময়ে ৬৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে; যা অর্জন করা অসম্ভব। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ক্ষেত্রে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১৬ শতাংশ। আয়ের বড় অংশ হচ্ছে ভ্যাট ও শুল্ক থেকে। অভ্যন্তরীণ মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বেড়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থানের কারণে আমদানি শুল্ক কমেছে। এতকিছুর পর আইএমএফ-এর নির্দেশনা অনুসরণ করে সরকার যে রাজস্ব বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন হবে না।
সিপিডি মনে করে, বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে সরকার অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ সুদে ঋণ নিচ্ছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিচ্ছে, ফলে তা দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিশোধে রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। এটা ভবিষ্যৎ মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে কর ফাঁকি ও কর এরিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। কর কাঠামোকে ডিজিটালাইজেশন ও অর্থ পাচার বন্ধ করার দিকে নজর দিতে হবে।
সরকারের প্রাধিকার প্রকল্প জনবান্ধব হতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের জন্য গাড়ি কেনা ও বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করতে হবে। এ মুহূর্তে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের বিকল্প নেই। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প পাচ্ছেন। তাদের জন্য সময়, ব্যয় ও বরাদ্দ বাড়ানো হয়। অর্থাৎ সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা ছাড়া ব্যয় কমানো সম্ভব নয়।