বিপন্ন উপকূল: চার কোটি মানুষের জীবন হুমকিতে

আবু সাইদ  বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ পরিবেশ বিপর্যয়ের কবলে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চল। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরের নোনা পানি ক্রমেই অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে ছাড়াও অমাবস্যা-পূর্ণিমায় অস্বাভাবিক জোয়ারে তলিয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে মিঠা পানির অভাবে উপকূলের বেশির ভাগ জমি এখন পতিত থাকছে। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় চার কোটি মানুষের জীবন ক্রমেই বেশি করে হুমকিতে পড়ছে। বাড়ছে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা। যত দিন যাচ্ছে, বন ও জলাভূমির পরিমাণ আশংকাজনক হারে কমছে। আবাসস্থলে খাদ্যের প্রাচুর্যতা কমে যাওয়ায় দিশাহীন হয়ে পড়ছে প্রাণীকূল। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সবুজ অরণ্য। সুন্দরবন সহ সড়কের পাশে শতশত বৃক্ষ মারা যাচ্ছে। বনভূমি সংকুচিত হওয়ার ফলে বন্যপ্রাণীদের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে, ফলদ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় গাছপালা নির্বিচারে উজাড় করে ফেলা হচ্ছে। এছাড়াও গাছ কাটার ফলে মাটির পানিধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে শীতের মৌসুমে দ্রুতই শুকিয়ে যাচ্ছে জলাধারগুলো। সম্মুখ বিপদ, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী হুমকি থেকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে নিজেদের আড়াল করতে পারছে । একই সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকাও হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। আর এর অন্যতম ভুক্তভোগী উপকূলীয় অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।

এদিকে “করবো ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখবো মরুময়তা অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সাতক্ষীরায় বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে বর্ণাঢ্য র‌্যালি, আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার (০৫ জুন) সকাল ৯টায় জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সাতক্ষীরার আয়োজনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে থেকে একটি বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের হয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আলোচনা সভায় মিলিত হয়। আলোচনা সভায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সরোয়ার হোসেন’র সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন এবং বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির। এছাড়া পরিবেশ সুরক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সাতক্ষীরায় সাইকেল র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার বিশ্ব পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বৈচিত্র রক্ষা টিমের উদ্যোগে সকাল ১১ টায় সাতক্ষীরা সদর উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে বের হওয়া র‌্যালিটি পুরাতন সাতক্ষীরা, সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ, পোস্ট অফিস, সদর হাসপাতাম, নিউ মার্কেট ও তুফান কোম্পানির মোড় হয়ে শহিদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে এসে শেষ হয়।
র‌্যালিতে অংশগ্রহণকারীরা ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’, ‘বন্যা খরা জলোচ্ছ্বাস, গাছ কাটলে সর্বনাশ’, ‘আসুন বৃক্ষরোপণ করি, খরা উষ্ণায়ন ও মরুময়তা রোধ করি’, ‘বৃক্ষ লাগাই ভুরি ভুরি, তপ্ত বায়ু শীতল করি’, গাছ লাগাতে কর না ভুল’, ‘আমরাই পারি সবুজ পৃথিবী গড়তে’- প্রভৃতি স্লেগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে সচেতনা মূলক স্লোগান দেন।
বিশেজ্ঞরা বলছেন, সরকারের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও অধিকাংশ এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মিত হয়নি। ষাটের দশকে নির্মিত বাঁধগুলোর অনেক স্থানই মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। টেকসই বাঁধ নির্মাণে সাতক্ষীরা, খুলনা, সহ উপকূলের কয়েকটি এলাকায় মেগা প্রকল্প নেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। ছোট ছোট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। গত কয়েক বছরে অনেকটা দায়সারাভাবে বাঁধ মেরামত করা হয়েছে। বাঁধের পাশের মাটি তুলে বাঁধে দেওয়া হয়েছে। এতে বাঁধের পাশের ভূমি দুর্বল হয়েছে। বাঁধ মেরামত করতে সেখানকার গাছ কেটে ফেলায় ঝুঁকি বেড়েছে।
ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধ্বংসী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয়গুলো বাংলাদেশে ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলছে। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী আরও ৪৫ লাখ শিশু নিয়মিত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় দ্বারা আক্রান্ত হয়।
জলবায়ু নিয়ে কাজ করা বিন্দু নারী উন্নয়ন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক জান্নাতুল মাওয়া বলেন, সব ধরনের দুর্যোগেই নারী, কিশোরী, গর্ভবতী, বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধীরা অধিক ঝুঁকির সম্মুখীন হন। ঘরহারা নারী ও কিশোরীরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন এবং যৌন হয়রানির স্বীকার হয়। বয়স্ক, গর্ভবর্তী এবং প্রতিবন্ধীদের চলাচলের সমস্যা দেখা যায়। তার পাশাপাশি সকলের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ে। শিশুরা নানান ধরনের সংকটে পড়ে। নারী শিশুরা বাল্য বিবাহের শিকার হয়।
সাতক্ষীরা শ্যামনগর আসনের সাবেক এমপি গাজী নজরুল ইসলাম জানান, পরিবেশ বিপর্যয় রুখতে এখুনি কাযকরী পদক্ষে গ্রহণ করতে হবে। বিশে করে ১। দেশের অনুমান ৬ হাজার কিলোমিটার উপকূলের বেড়িবাঁধ সংস্কার করে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। উদহারণ হিসেবে বলা যায়- কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের ন্যায় দেশের উপকূলের বেড়িবাঁধের উপর মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করা যেতে পারে। ২। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের বাঘ হরিণসহ বন্যপ্রাণীদের রক্ষা করতে বনের মধ্যে উঁচু আশ্রয়স্থল তৈরি করতে হবে। যাতে ঝড় জলোচ্ছ্বাসের সময় পানি বৃদ্ধি পেলে সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। ৩। ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষি, কৃষকদের সুদমুক্ত দীর্ঘমেয়াদী ঋণসুবিধা দিতে হবে। ৪। উপকূল নিকটবর্তী সকল নদ-নদী, খালের নাব্যতা বৃদ্ধি করে পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে উপকূলে সবুজ বেস্টনী গড়ে তুলতে হবে। ৫। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে আরো কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে।

এ দিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় জেলা প্রশাসক হুমায়ুন করিব বলেন, এ নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর জোয়ার বৃদ্ধির ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি যাতে প্রবেশ না করে, সে জন্য বাঁধগুলো টেকসই করার চেষ্টা করছি। জলাবদ্ধতা দূরসহ আরও যে সমস্যা রয়েছে সেগুলোকে রোধ করার জন্য জেলা প্রশাসক অফিস কাজ করছে।

 

Please follow and like us:

Check Also

নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ, বাংলাদেশিদের মৌলিক স্বাধীনতা চর্চার সক্ষমতা দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

বাংলাদেশে চলমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের কথা আরও একবার জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে ২০শে জুলাই …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।