আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে দেশের সমুদ্র উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ বহুমাত্রিক সংকটে পড়ছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, খাদ্য, বসতি, বিশুদ্ধ পানীয় জল, যাতায়াত এবং নিরাপত্তাহীনতায় পতিত হতে হচ্ছে তাদের। বিশেজ্ঞরা বলছেন, যে হারে জাতীয় বাজেটের আকার বাড়ছে সে হারে জলবায়ু ও দুর্যোগ প্রশমন খাতে বরাদ্দ বাড়ছে না। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রতিনিয়ত আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে বাংলাদেশ। অথচ প্রয়োজনের তুলনায় এ মন্ত্রণালয় বাজেটে বরাদ্দ পাচ্ছে কম। এতে দেশের সমুদ্র উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, যশোর, ভোলা, কক্সবাজার জেলার মানুষকে চরম সংকটে ফেলছে। এর বান্তব প্রমাণ পাওয়া গেছে সদ্য সমাপ্ত ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ দেশের উপকূলীয় উপকূলে আঘাতে সম্পদ ও বাড়িঘর, পশুপাখি, মাছসহ তাদের মূল্যবান সম্পদের ক্ষতি। আবার এসব অঞ্চলের নদীসমূহ অতিমাত্রায় জোয়ার-ভাটার কারণে প্রতিদিন নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এসব নদীতে সাগর থেকে জোয়ারের পানি আসে এবং ভাটায় ফিরে যায়। এ নদীগুলোর সঙ্গে পদ্মাপ্রবাহের কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে সমগ্র এলাকা হচ্ছে জোয়ার-ভাটার প্লাবনভূমি। এদিকে চলতি জাতীয় বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের জনগণ চরম বৈষম্যের শিকার বলে অভিযোগ উঠেছে। বরাদ্দের অভাবে উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সুপেয় পানি সরবরাহে সরকারের নেওয়া প্রকল্পগুলো আটকে আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত দেখভালের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)-র পর্যাপ্ত জনবল নেই বলে দুর্যোগের সময় বাঁধগুলোর অকার্যকারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সারা দেশে উপকুলীয় এলাকায় ১৯ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। কিন্তু এই বাঁধের অর্ধেকই ঝঁকিপূর্ণ।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের গত কয়েক বছরের বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা এক লাফে ৭৩১ কোটি টাকা কমিয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ হাজার ২৭১ কোটি ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের জন্য অর্থায়ন আরও কমে বরাদ্দ দাঁড়ায় ১ হাজার ২৪৬ কোটি টাকায়। ২০২১-২২ অর্থবছরে সেটি আরও কমে হয় ১ হাজার ২২১ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ বেড়ে হয় ১ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৮ কোটি টাকায়। সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বরাদ্দ বেড়ে হয় ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বিগত কয়েক বছরে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। সুন্দরবন থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ টন গাছের পাতা এ অঞ্চলের গভীর জোয়ারের পানি নদীতে পড়ে এবং তা ধীরে ধীরে জলজ প্রাণীর খাদ্যকণায় রূপান্তরিত হয়। উপকূলীয় বাঁধ হওয়ার আগে জোয়ারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ জলরাশি নদীগুলোর দুকূল ছাপিয়ে প্লাবনভূমিতে উঠে আসত এবং জোয়ারবাহিত পলি প্লাবনভূমিতে পড়ে তীব্র ¯্রােতে ভাটায় তা ফিরে যেত। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেমন জোয়ার-ভাটার নদীগুলোর নাব্য বজায় থাকত, তেমনি ভূমির গঠন প্রক্রিয়া সমানতালে চলত। ফলে নদীর নাব্য থাকত। এ কারণে এখানকার নদী, প্রকৃতি, পরিবেশ ও কৃষিব্যবস্থা এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী; দেশের অন্যান্য উপকূল থেকে তা ভিন্নতর; কিন্তু এখানকার প্রকৃতি ও প্রতিবেশকে বিবেচনায় না নিয়ে ষাটের দশকে উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্পের আওতায় এ অঞ্চলে ৩৯টি পোল্ডার নির্মাণ করা হয়, এর আওতায় ১ হাজার ৫৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ ও ২৮২টি স্লুইসগেট নির্মিত হয়। এ কারণে এই নদীগুলো স্থায়ীভাবে প্লাবনভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যার ফলে জোয়ারবাহিত পলি প্লাবনভূমিতে পতিত হতে না পেরে নদীতে অবক্ষেপিত হচ্ছে এবং ইতোমধ্যে বহু নদী মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। অবশিষ্ট জোয়ার-ভাটার নদীগুলো পলি দ্বারা ভরাট হয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর ফলে বিগত শতকের আশির দশকে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা এবং ধীরে ধীরে তা হয়ে উঠেছে প্রলয়ঙ্করী ও বিধ্বংসী। এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের ৪৩.৯৫ শতাংশ মানুষের ভালো ঘুম হয় না বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে।
উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর আসনের তিনবারের সংসদ গাজী নজরুল ইসলাম বলেন,” উপকূলে মাটির বাঁধের কোনো বিকল্প নেই। সমস্যা হচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণর। আমাদের এখানে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে যত খরচ করি, সেটা রক্ষণাবেক্ষণে তেমন বরাদ্দ দেয়া হয় না। সেটা যদি হতো, তাহলে এই বাঁধগুলোর এই অবস্থা হতো না।” “১৯৬০ সালে এই বাঁধগুলো যখন ডিজাইন করা হয়, তখন সেটার উচ্চতা ধরা হয়েছিল ৪.৭ মিটার। আমরা যদি ওই উচ্চতা ধরে রাখতে পারতাম, তাহলে তো আর সমস্যা হতো না। সেটা তো হয়নি। অনেক জায়গায় বাঁধ নিচু হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় অস্তিত্বই নাই। তার কথা, ” সিমেন্টের ব্লক ফেলে, বালুর বস্তা ফেলে এর কোনো সমাধান হবে না। ওটা আকস্মিক কোনো সমস্যার সমাধান। মূল সমাধান হলো রক্ষণাবেক্ষণ করে বাঁধগুলোকে তার সঠিক অবস্থানে ফিরিয়ে আনা।”
জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়ন সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসাইন খান বলেন, ‘বাজেটে আমাদের জলবায়ু খাতের বরাদ্দ পরিকল্পনা মাফিক ও পর্যাপ্ত হচ্ছে না। আগামী পাঁচ বছরে কোথায় কোথায় ঝুঁকি বাড়বে, সে অনুযায়ী অ্যাসেসমেন্ট করে বাজেট হওয়া উচিত । সংশ্লিষ্টদের মতে, আগে বেড়িবাঁধে ৬ মাস সময় নিয়ে মাটি ভরাট করা হতো। বিশেষ করে ডিসেম্বরে মাটি ভরাট শুরু হতো, শেষ হতো জুনে। প্রায় ৬ মাস মাটি ভরাটের ফলে মাটি স্বাভাবিক নিয়মে ভালোভাবে বসে শক্ত বাঁধ তৈরি হতো। এখন বেড়িবাঁধের টেন্ডারে সর্বোচ্চ ৩ মাস বা ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়। অনেক সময় আরও কম সময়ে বর্ষার মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে বেড়িবাঁধের কাজ করতে হয়। এতে কাজের মান বলে কিছু থাকে না। ফলে সামান্য জোয়ারের পানিতে ভেঙে যায় বাঁধ।
আশাশুনির প্রতাব অঞ্চলে বাসিন্ধা শাহিন জানান, প্রতিবছর প্রতাবনগর রক্ষা বাঁধে ক্ষতি হয়। ইঁদুর গর্ত খুঁড়ে, অন্যান্য প্রাণীও গর্ত তৈরি করে, ছিন্নমূল মানুষ বেড়িবাঁধের ঢালুতে ঘর তৈরি করে বসবাস করে। অনেকে বেড়িবাঁধের ওপর নানা ধরনের গাছ, শাকসবজি আবাদ করে। এসব দেখভালে উপজেলা পর্যায়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন জনবলও নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা যে ডিজাইনে বেড়িবাঁধ তৈরি করতে বলি, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমলেই নেওয়া হয় না। প্রতিটি লেয়ারে রোলার দিয়ে মাটি ভালোভাবে বসিয়ে বাঁধ তৈরি করার ডিজাইন দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, উপকূলের প্রভাবশালীরা নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বেড়িবাঁধের নিচ দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে ড্রেজিং করে। তাদের বাধা দেওয়ার সাধ্য কারও নেই। ড্রেজিং বন্ধ করার পর বেড়িবাঁধের নিচ দিয়ে পাইপ ঢুকানোর গর্ত ভরাট করে না। ফলে অতিবর্ষণ ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে বাঁধ ভেঙে এলাকার পর এলাকা প্লাবিত হয়।
Check Also
সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …