বাঘ, হাতি, কুমির ও ভালুকের আক্রমণে কেউ মারা গেলে কিংবা আহত হলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে; কিন্তু সাপের কামড়ে হতাহত হলে কোনো ক্ষতিপূরণ নেই। অথচ দেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ সাপের কামড়ে মারা যান। আর সরীসৃপ এই প্রাণীর আক্রমণের শিকার হন চার লাখের বেশি মানুষ।
এ অবস্থায় সাপের আক্রমণে কেউ আহত বা মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গত শনিবার বন বিভাগের এক আলোচনা সভা থেকে এমন পরামর্শ উঠে এসেছে।
বর্ষার এ সময় সাপের উপদ্রব বেশি থাকে। দরিদ্র এসব মানুষ একবার সাপের কামড়ের শিকার হলে তাঁদের আর্থিক, সামাজিক ক্ষতি হয়। আমাদের আইনে অন্য প্রাণীর পাশাপাশি সাপের কামড়ে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি যুক্ত করতে হবে।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের উদ্যোগে ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু বন্য প্রাণী অ্যাওয়ার্ড-২০২৪ জয়ী ও সাপবিশেষজ্ঞ আবু সাঈদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে সাপের কামড়ের সবচেয়ে বেশি শিকার হন কৃষকেরা। চর এলাকায় বর্ষার এ সময় সাপের উপদ্রব বেশি থাকে। দরিদ্র এসব মানুষ একবার সাপের কামড়ের শিকার হলে তাঁদের আর্থিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি হয়। অন্যদিকে সাপ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্য প্রাণী। তাই সাপও মারতে দেওয়া যাবে না। আবার মানুষের ক্ষতি হলে তা পূরণেরও ব্যবস্থাও নিতে হবে। এ কারণে আমাদের আইনে অন্য প্রাণীর পাশাপাশি সাপের কামড়ে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি যুক্ত করতে হবে।’
জানা গেছে, ‘বন্য প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত জানমালের ক্ষতিপূরণ বিধিমালা-২০২১’-এ সাপের কামড়ে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি আমলেই নেওয়া হয়নি। বিধিমালায় বাঘ, হাতি, কুমির ও ভালুকের আক্রমণে মৃত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ২০২১ সালে ওই বিধিমালা সংশোধন করে তাতে সাফারি পার্কে যেকোনো প্রাণীর আক্রমণের শিকার হলেও ক্ষতিপূরণের বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে সাপের কামড়ের সবচেয়ে বেশি শিকার হন কৃষকেরা। চর এলাকায় বর্ষার এ সময় সাপের উপদ্রব বেশি থাকে। দরিদ্র এসব মানুষ একবার সাপের কামড়ের শিকার হলে তাঁদের আর্থিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি হয়।
সাপবিশেষজ্ঞ আবু সাঈদ
সাপের কামড়ে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে জাতীয়ভাবে জরিপ আছে। সেই জরিপের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ মোট ১১টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান যুক্ত ছিল। ২০২১ ও ২০২২ সালে তারা মাঠপর্যায়ে জরিপটি করে। এর আগে এই সংস্থাগুলো ২০০৮ সালে আরেকটি জরিপ করেছিল। তাতে বছরে ছয় হাজারের বেশি মানুষের সাপের কামড়ে মৃত্যু ঘটে বলে বেরিয়ে আসে। ওই জরিপে বছরে ছয় লাখের বেশি মানুষ সাপের আক্রমণের শিকার হন বলে জানানো হয়।
সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, দেশে সবচেয়ে বেশি সাপের কামড়ের শিকার হন খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের মানুষ। সম্প্রতি চন্দ্রবোড়ার আক্রমণ নিয়ে বেশি আলোচনা হলেও বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান গোখরা ও কালকেউটের কামড়ে। আর সবচেয়ে বেশি মানুষ সাপের আক্রমণের শিকার হন মে, জুন ও জুলাই মাসে। মূলত বর্ষায় দেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষ এবং বন্যার সময় উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন বেশি।
জানতে চাইলে বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. ইমরান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাপের কামড়ে বাংলাদেশে অনেক মানুষ আহত হন ও মারা যান। এত মানুষকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া কঠিন। তবে আমাদের সভায় অনেকে ক্ষতিপূরণের তালিকায় সাপের নাম যুক্ত করার বিষয়টি তুলেছেন। তাঁরা মন্ত্রণালয়ের কাছে বিষয়টি তুলে ধরবেন।’
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান গোখরা ও কালকেউটের কামড়ে। আর সবচেয়ে বেশি মানুষ সাপের আক্রমণের শিকার হন মে, জুন ও জুলাই মাসে। মূলত বর্ষায় দেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষ এবং বন্যার সময় উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন বেশি।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে বছরে ৯০ থেকে ১১০ জন হাতি, ভালুক, বাঘ ও কুমিরের আক্রমণে মারা যান। তাঁদের পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। আহত ব্যক্তিরাও ক্ষতিপূরণ পান। এ জন্য নির্দিষ্ট ফরমে প্রমাণসহ আবেদন করতে হয়। প্রক্রিয়াটি জটিল হওয়ায় অনেকে ওই আবেদন করতে পারেন না।
ওই চার বন্য প্রাণীর আক্রমণে কারও মৃত্যু হলে তিন লাখ টাকা, গুরুতর আহত হলে অনধিক এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান আছে। সরকারি বনাঞ্চলের বাইরে লোকালয়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হলে অনধিক ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে।
সাপ ও সাপের বিষ নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির প্রধান এম এ ফয়েজ প্রথম আলোকে বলেন, বেশির ভাগ কৃষক নিজের অজান্তে সাপের কামড়ের শিকার হন। তাই বন্য প্রাণীর আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতিবিষয়ক বিধিমালায় সাপের নাম যুক্ত হওয়া উচিত।