নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ষান্মাসিক (অর্ধবার্ষিক) পরীক্ষার মূল্যায়ন শুরু হচ্ছে ৩ জুলাই। শেষ হবে ৩০ জুলাই। অথচ এখনো শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত হয়নি। এ বিষয়ে গত ২ বছর ধরে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রথমে নম্বর ও গ্রেডিং পদ্ধতি বাতিল করে ‘ত্রিভুজ’, ‘বৃত্ত’ ও ‘চতুর্ভুজ’ ইনডিকেটর ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মূল্যায়ন শুরু হয়। এ নিয়ে অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টদের তীব্র সমালোচনার মুখে তা থেকে পিছু হটে কর্তৃপক্ষ। এরপর মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী। গঠন করেন উচ্চপর্যায়ের কমিটিও। সেই কমিটির মতামতের ভিত্তিতে বিভিন্ন পর্যায়ে মূল্যায়নের খসড়া তৈরি করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। পরে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরীক্ষা শুরু হতে সময় বাকি আছে আর মাত্র ৩ দিন। কিন্তু সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ফলে অর্ধবার্ষিক মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, চলতি শিক্ষাবর্ষে মূল্যায়ন কাঠামো বাস্তবায়নে কয়েকটি ধাপ ঠিক করা হয়েছে। প্রথম ধাপে পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়নের আদলে চলতি বছরের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ষান্মাসিক (অর্ধবার্ষিক) সামষ্টিক মূল্যায়ন পরিচালনা করার পরিকল্পনা করা হয়। এছাড়া একটি কর্মদিবসে একটি বিষয়ের মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হবে বিরতিসহ ৫ ঘণ্টায়।
মূল্যায়নে লিখিত অংশও থাকবে। ষান্মাসিক মূল্যায়নে যুক্ত হবে শিক্ষার্থীর শিখনকালীন পারদর্শিতা, অর্থাৎ সে কতটুকু শিখতে পারল। ৬ মাসের মূল্যায়নের পর বছর শেষে অনুষ্ঠিত হবে বার্ষিক মূল্যায়ন। বার্ষিক মূল্যায়ন শেষে পরবর্তী শ্রেণিতে উঠতে না পারলেও শিক্ষার্থীকে দেওয়া হবে রিপোর্ট কার্ড। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির মূল্যায়নের রিপোর্ট কার্ডে উল্লেখ থাকবে বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতার ক্ষেত্র (নির্ধারিত কোনো ক্ষেত্রে কতটা দক্ষ), উপস্থিতির হার ও শিক্ষার্থীর আচরণগত মূল্যায়ন দক্ষতা। উল্লেখ, থাকবে শিক্ষকের মন্তব্যের পাশাপাশি অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর মন্তব্যও।
এদিকে সামষ্টিক মূল্যায়ন বা লিখিত অংশে ৬৫ নম্বর এবং শিখনকালীন মূল্যায়ন বা শ্রেণি কার্যক্রমে ৩৫ নম্বর রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শ্রেণি কার্যক্রম বলতে বোঝানো হয়েছে অ্যাসাইনমেন্ট, উপস্থাপন, অনুসন্ধান, প্রদর্শন, সমস্যার সমাধান, পরিকল্পনা প্রণয়নের মতো কাজ। এছাড়া আগে এসএসসি-এইচএসসিতে ৩ ঘণ্টার পরীক্ষা হলেও নতুন কারিকুলামে প্রতিটি বিষয়ের মূল্যায়ন হবে ৫ ঘণ্টায়।
পাবলিক পরীক্ষায় মোট ১০টি বিষয়ের ওপর শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। মূল্যায়নের পর্যায়গুলো হবে অনন্য, অর্জনমুখী, অগ্রগামী, সক্রিয়, অনুসন্ধানী, বিকাশমান ও প্রারম্ভিক। সবচেয়ে যে ভালো করবে সে ‘অনন্য’ পাবে। এভাবে অন্য পর্যায়গুলো দিয়েও মূল্যায়ন করা হবে। তবে সব বিষয়ের স্কেল মিলিয়ে তা সমন্বিতভাবে প্রকাশ করা হবে না।
এ বছরের শেষে নবম শ্রেণির বার্ষিক মূল্যায়নও একইভাবে নেওয়ার পরিকল্পনা আছে। ওই সময় কিছু এলাকায় পাইলটিং হিসাবে এসএসসি পরীক্ষার আদলে কেন্দ্রভিত্তিক মূল্যায়নের পরিকল্পনাও রয়েছে। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রায় ৬ মাস পড়াশোনা শেষ করলেও তারা সুনির্দিষ্টভাবে জানে না মূল্যায়নটি কেমন হবে।
গত বছর দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়। এতে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তমসহ মোট তিন শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা হয়। চলতি বছর বাস্তবায়ন করা হচ্ছে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবমসহ চারটি শ্রেণিতে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে এ শিক্ষাক্রম ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। মূল্যায়ন তথ্য সংরক্ষণের জন্য ‘নৈপুণ্য’ নামে অ্যাপ চালু করা হয়েছে; কিন্তু পাবলিক পরীক্ষার জন্য সেটি যুগোপযোগী করতে হবে; কিন্তু সেই কাজও থেমে আছে।
মূল্যায়ন কাঠামো চূড়ান্ত না হওয়ায় সঠিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও রয়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্বে। মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত না হওয়ায় অভিভাকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
নতুন মূল্যায়নের খসড়ায় এসএসসিতে কেউ দুই বিষয়ে ফেল করলেও এইচএসসিতে ভর্তি হতে পারবে। কিন্তু তারা পূর্ণ সনদ পাবে না। তবে মার্কশিট পাবে। পূর্ণ সনদ পেতে পরে দুই বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হবে। তবে বিষয়টি ভালোভাবে নেননি অভিভাবকরা। তারা বলছেন, কোনো শিক্ষার্থী যদি ফেল করে উপরের শ্রেণিতে ওঠার সুযোগ পায়, সে পড়াশোনায় মনোযোগী হবে না।
জানা গেছে, শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্তকরণসংক্রান্ত কমিটির একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেটি আরও সুচারুরূপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতামতের পরই চূড়ান্ত হবে নতুন কারিকুলামের মূল্যায়ন পদ্ধতি। তবে এ নিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সভা ডেকেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ১ জুলাই দুপুরে মাধ্যমিক স্তর এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা স্তরের এনসিসিসির যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে মূল্যায়ন পদ্ধতি এখনো চূড়ান্ত না হওয়ায় শিক্ষকরা বুঝে উঠতে পারছেন না কিভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন। এই বিষয়ে তেমন কোনো প্রশিক্ষণও পাননি তারা। অপরদিকে ষান্মাসিক পরীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে শিক্ষার্থীরা। তাদের পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি কেমন হবে? একটা নতুন পদ্ধতি চালু করার আগে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ও অভিভাবকদের বুঝে উঠতে সময়ের প্রয়োজন হয়।
এ নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ নেই। এ বিষয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক রোকনুজ্জামান শেখ যুগান্তরকে বলেন, ৩ জুলাই থেকে মাধ্যমিকের সব শ্রেণির ষান্মাসিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তবে পরীক্ষার মূল্যায়ন চূড়ান্ত না হলেও এনসিটিবির কিছু দিকনির্দেশনা আমরা পেয়েছি। প্রতিটি পরীক্ষা গ্রহণের আগে রাতে ওই বিষয়ে চূড়ান্ত নির্দেশনা জানাবে এনসিটিবি। এই নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বলে জানান তিনি।