ভারতীয় জেলেদের জালে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ॥ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ

আবু সাইদ বিশ্বাস: জলবায়ু পরিবর্তনে ইলিশের জীবন ও বংশ বিস্তারে বিরূপ প্রভাব, বছরে তিন দফায় মোটাদাগে পাঁচ মাসের মতো ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা, দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে ভারতীয় জেলেরা মাছ ধরাসহ সরকারের নানা ব্যর্থতার কারণে চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলের কয়েক লক্ষ জেলে। বিগত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, দেশে ইলিশ উৎপাদন কাক্সিক্ষত হারে না বাড়লেও পশ্চিমবঙ্গের জেলেরা একচেটিয়া ইলিশ আহরণের সুযোগ পাচ্ছেন। নিষেধাজ্ঞার সময় ভারতীয় অংশে বেশি ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। আবার বাংলাদেশ অংশে মাছ আহরণ বন্ধ থাকায় অবাধে বাংলাদেশ সীমানায় ঢুকে ইলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছেন ভারতীয় জেলেরা। পশ্চিমবঙ্গে সেভাবে এখনো বর্ষা শুরু হয়নি। তবে মৌসুমের শুরুতেই রাজ্যে জেলেদের জালে ধরা পড়ছে ইলিশ। সম্প্রতি কাকদ্বীপ, দীঘা, নামখানা, ডায়মন্ড হারবারে রুপালি ইলিশের দেখা মিলেছে। ফলে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু খুচরা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ইলিশ। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বাংলাদেশে একাধিকবার ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞায় সুবিধা বাড়ছে ভারতের। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ইলিশ সুরক্ষা এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে বছরে তিনবার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। অক্টোবরে মা মাছের ডিম ছাড়ার জন্য ২২দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকে। এরপর বাচ্চা হলে তার সুরক্ষায় ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল নিষেধাজ্ঞা থাকে। আবার, মাছের বৃদ্ধির জন্য ২০মে থেকে ২৩জুলাই পর্যন্ত আরও এক দফায় সাগরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই নিষেধাজ্ঞা থাকা ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত। তবে বাংলাদেশের অনেক মৎস্যজীবীর মতে, ভারত এবং বাংলাদেশ মিলিয়ে একটি অভিন্ন সময়ে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা উচিত। এই নিয়ে তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের মৎস্যমন্ত্রকের সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর। পশ্চিমবঙ্গের ফিশ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অতুল দাস বলেন, ‘বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যজীবীদের মাছের উৎস একই। তাই এক অংশে যদি মাছ ধরা বন্ধ থাকে, অন্য অংশে মাছ ধরা বেশি পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’

মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, ইলিশের ৭৫ শতাংশ উৎপাদন বাংলাদেশের উপকূলে। বাদবাকি লাগোয়া ভারতের অংশে উৎপাদন হয়। সঙ্গত কারণে নিষেধাজ্ঞার সময় নতুন করে পুনর্বিন্যাস করা দরকার বলে মনে করেন জেলেরা। বিশেষজ্ঞরা জানান, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমন্বয় করে অভিন্ন সময় নির্ধারণ করা না হলে নিষেধাজ্ঞার সুফল মিলবে না। সূত্রমতে, বঙ্গোপসাগরের আন্তর্জাতিক সীমা বা ইনোসেন্ট প্যাসেজ পেরিয়ে বাংলাদেশের অন্তত ৫০ নটিক্যাল মাইল অভ্যন্তরে ঢুকে ভারতীয় জেলেরা মাছ ধরছে বলে অভিযোগ বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির। বিশেষ করে বাংলাদেশে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার সুযোগে ভারতীয় মাছ ধরার কয়েকশ’ অত্যাধুনিক ট্রলার এখন এই সমুদ্রসীমা চষে বেড়াচ্ছে। তথ্য নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার জলসীমার মধ্যে তীর থেকে ৩৬৭ কিলোমিটার বা ২০০ নটিক্যাল মাইলকে বলা হয় অর্থনৈতিক সমুদ্র সীমা। মূলত এখানেই বাংলাদেশের জেলেরা মাছ ধরার সুযোগ পায়। এর বাইরে আন্তর্জাতিক সীমা বা ইনোসেন্ট প্যাসেজে দুদেশের নৌকা কিংবা ট্রলারগুলো যেতে পারলেও মাছ ধরার সুযোগ নেই। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৫ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। চার বছরে বার্ষিক উৎপাদন ৬ লাখ ২০ হাজার টন বা ১৬ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে মৎস্য অধিদপ্তর। তবে ৩ বছরে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের কম।

ভারতে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকায় অন্তত তিন হাজার মাছ ধরার ট্রলার ইলিশ ধরতে সমুদ্রে নেমেছে। পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে ইলিশ ধরা পড়ছে অপেক্ষাকৃত বেশি হারে। এর মধ্যে দেড় থেকে দুই কেজির ইলিশও আছে। মৎস্য ব্যবসায়ী রাম চন্দ্র বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মৎস্যজীবীদের মাছের উৎস তো একই, সেই বঙ্গোপসাগর। তাই এখানে এক অংশে যদি মাছ ধরা বন্ধ থাকে, অন্য অংশে তো মাছ ধরা বেশি পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে মাছ ধরা শুরু হলে আমাদের এখানে কমে যাবে।’

জেলেসহ ট্রলার মালিকদের অভিযোগ, গত ২০ মে থেকে বাংলাদেশ সীমানায় মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির সুযোগে ভারতীয় জেলেরা এখন এ অঞ্চলে অবাধে মাছ শিকার করছে। এমনকি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকেও মাছ শিকারের অভিযোগ রয়েছে ভারতীয় জেলেদের বিরুদ্ধে। জেলেদের একজন বলেন, ‘আমাদের দেশে অবরোধ কিন্তু ভারতে অবরোধ নেই। তারা বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে বাংলাদেশের ইলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এতে আমরা ক্ষি তগ্রস্ত হচ্ছি।’ বাংলাদেশ ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরীর গণমাধ্যকে বলেন, ‘আমাদের দেশে যখন মাছ শিকার বন্ধ থাকে তখন বিদেশি ট্রলারগুলো আমাদের দেশে এসে মাছ ধরে নিয়ে যায়। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম কিন্তু আমরা কোথাও প্রতিকার পাচ্ছিলাম না।’তিনি আরও বলেন, ‘ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ বন্ধে বিগত দিনে আমরা আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। কিন্তু কোনো কাজের কাজ হয়নি। বরং বীরদর্পে তারা (ভারতীয়রা) দেশীয় জলসীমায় অতিক্রম করে মাছ শিকার করছে।’

‘সাগরের বিশাল জলরাশির সাথে জীবন-মরণ যুদ্ধ করি প্রতিনিয়ত। কখনো ট্রলারসহ ডুবে যাই আবার কখনো ট্রলারের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে ভাসতে ভাসতে চলে যাই গভীর থেকে গভীর সাগরে। তখন নির্ভর করি ভাগ্য বিধাতার ওপরে।

কখনো ভাসা ধরে ভাসতে ভাসতে উঠে যাই সুন্দরবন। আবার ক্লান্ত শরীর নিয়ে হিংগ্র  বাঘের তাড়া খেয়ে উঠে যাই গাছের মগ ডালে। সব কিছু মানতে পারি। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতেই পারে। তবে মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগে পড়লে সেটা কেমন লাগবে। আপনার রিজিক কেউ নষ্ট করলে আপনি তাকে ছেড়ে দেবেন? না দেবেন না। কিন্তু আমরা ছেড়ে দিয়ে আসি। কারণ বাঘ-বিড়ালের লড়াইয়ে কে জিতবে সবার জানা, বিশাল আকৃতির ট্রলিং জাহাজ ও বড় ফিশিং বোর্ডের সাথে আমাদের ছোট ছোট ট্রলার পারবে কিভাবে। নির্যাতিত হয়ে যখন কোষ্টগার্ড বা নৌবাহিনীর কাছে বলতে যাই তখন আবার ধমক খেয়ে চলে আসি।’ বলছিলেন নাম প্রকাশ্যে অনিচ্চুক কয়েকজন জেলে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায় থেকেই দাবি উঠেছে সাগরে মাছ ধরার বিষয়ে অভিন্ন সময় নির্ধারণ নিয়ে কূটনৈতিক স্তরে কথা বলার। মৎস্য অধিদপ্তরের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, বিষয়টি মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। কয়েক মাস আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার মন্ত্রণালয়ে এলে মন্ত্রী তাঁকে জানিয়েছেন।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।