আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: পৃথিবীর শীর্ষ দশে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিতে আছে, তার মাঝে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল অন্যতম। বেশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশে গত ৩০ বছর ধরে উপকূলবর্তী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিবছর ৩ দশমিক ৮ থেকে ৫ দশমিক ৮ মিলিমিটার পর্যন্ত বাড়ছে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইসিসিসিএডি)-এর তথ্য অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলের মানুষের ঘরবাড়ি ও জীবিকা বিপন্ন হওয়ার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় নয় লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। এ কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১২ থেকে ১৮ শতাংশ ডুবে যাওয়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্য দিকে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে নদ-নদীতে পানির প্রবাহ বেড়ে গিয়ে প্রতি বছরই দেশে বন্যা দেখা দিচ্ছে। আর দীর্ঘ সময় ধরে চলা শুষ্ক আবহাওয়া, অপর্যাপ্ত বৃষ্টি, বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীভবন ও প্রস্বেদনের পরিমাণ বেশি হলে খরার সৃষ্টি হয়। এর বাইরে গত ৪৩ বছরে শীতের ক্ষেত্রেও বেশ পরিবর্তন এসেছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি, সুপেয় পানির অভাব, কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাওয়াসহ নানা কারণে দেশের ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। উদ্বাস্তুদের সেই প্রক্রিয়া ইত্যোমধ্যে উপকূলীয় জেলা সমূহে শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে জলবায়ু অভিবাসীদের সংখ্যা ৭০ লাখ ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে সেই ধারা অব্যাহত থাকলে রাজধানী ঢাকাসহ পাঁচটি বড় শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। যে কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এড়াতে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ সমূহের কার্যকরী বাস্তবায়ন দেখতে চান পরিবেশ বিশেজ্ঞরা।
বিশ্ব আবহায়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) এর মতে গত ৫০ বছরে শুধু দুর্যোগে বাংলাদেশেই প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দ্য ল্যানসেট মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সাল থেকে বিশ্বে আবহাওয়া সংক্রান্ত দুর্যোগ ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বিশ্বে ৭৯৮টি চরম দুর্যোগপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ১৯৮০ দশকে বছরে যেখানে বৈশি^ক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২০০ কোটি ডলার, এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার কোটি ডলারে। গত ৩০ বছরে প্রতিবছর গড়ে বৈশ্বিক জিডিপির ২ শতাংশ হারাতে হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। আগামী দশকে তা ৯ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার জীবনমানে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনের প্রভাব শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষের জীবনযাত্রার মানে অবনতি ঘটবে। খুলনা আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল মে মাসে ৩৪.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১২ সালে ৩৬.৭, ২০১৩ সালের জুনে ৩৩.৯, ২০১৪ সালে ৩৬.৮, ২০১৫ সালে ৩৬, ২০১৬ সালের এপ্রিলে ৩৬.৩, ২০১৭ সালের মে মাসে ৩৫.৯, ২০১৮ সালের এপ্রিলে ৩৩.৮, ২০১৯ সালের মে মাসে ৩৬.২, ২০২০ সালের এপ্রিলে ৩৪.৪, ২০২১ সালের এপ্রিলে ৩৬.৪, ২০২২ সালের এপ্রিলে ৩৫.২, ২০২৩ সালের ৩৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত রেকর্ড ৪১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্পর্শ করে, যা ১৪ বছরের রেকর্ড।
সাতক্ষীরা ৪, শ্যামনগর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গাজী নজরুল ইসলাম বলেন, শ্যামনগর ও আশাশুনি মূলত উপকূলীয় এলাকা। গত তিন-চার দশকে এ অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও দুর্যোগে মানুষের কর্মসংস্থান কমে গেছে। প্রায় ৫০ শতাংশ কর্মজীবী মানুষ কাজের জন্য এলাকা ছেড়েছে। এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মুহা হুমায়ুন কবির বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (বিসিসিএসএপি) ২০০৯, বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০, মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান ২০৩০ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এড়াতে নেয়া এসব পদক্ষেপের যথাযথ বাস্তবায়ন চান সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি বাংলাদেশকে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনগুলোয় নিজের অবস্থান আরো বেশি শক্তিশালী করা, যেসব উন্নত দেশ অত্যধিক হারে কার্বন নিঃসরণ করে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে, তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক বৈঠকের আয়োজন করাসহ তাদের কর্মকান্ডের ফলে এ দেশ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরার পরামর্শ জলবায়ু বিশেজ্ঞদের।