, আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ জলবায়ু পরিবর্তনজনিতসহ নানা কারণে ভিটে-মাটি হারিয়ে যারা সড়কের পাশে অর্ধশত বছর ধরে যারা বসবাস করে আসছে তারা এখন খোলা আকাশের নিচে। সবার চোখে মুখে ক্লান্তিও অনিশ্চিয়তার ছাপ। কোথায় যাবেন কোথায়, কোথায় থাকবেন জানা নেই এই বাস্তুহারা মানুষগুলোর। এসব পরিবারের কথা বিবেচনায় না নিয়েই সাতক্ষীরাকে ভূমিহীন ও গৃহহীন মুক্ত ঘোষণা করায় পরিবারগুলো পথে বসেছে। শুধু ইটাগাছা বস্তি নয়, এমন হাজারো পরিবার এখনো সাতক্ষীরা জেলায় রয়েছে, যারা ভূমিহীন। যাদের থাকায় নিরাপদ জায়গা নেই। প্রসঙ্গত, সোমবার (১ জুলাই) থেকে সাতক্ষীরা-শ্যামনগর সড়ক উন্নয়নের লক্ষ্যে সড়কের দুইপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু করেছে সড়ক ও জনপদ বিভাগ। এতে আশ্রয়হীন হওয়ার শঙ্কায় সড়কের পাশে বসবাস করা কয়েক হাজার পরিবার। এসব পরিবারে কেউ ভ্যান-রিক্সা চালায়, কেউ জোগাড়ি দেয়, কেউ দিনমজুরের কাজ করে। কেউ স্ব^ামী পরিত্যাক্তা, কেউ বিধবা, কেউবা প্রতিবন্ধী। তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই বলেই তারা খোলা আকাশের নিচে পলিথিন টানিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এভাবেই ফাঁকা মাঠে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ সড়কের দু’পাশ থেকে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলোর। এদিকে ইটাগাছা এলাকার খোকন বিশ্বাসসহ অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, পূর্বে তাদের কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি। এমনকি ঘরে থাকা খাবারগুলোও সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া সাতক্ষীরা নিউ মার্কেট থেকে অবৈধ স্থাপনা অপসারণ কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা থাকলেও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বড়লোকদের অবৈধ স্থাপনা রেখে গরীবের অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করা হচ্ছে। এদিকে সাতক্ষীরায় সড়কের পাশ থেকে উচ্ছেদকৃত অসহায় ভূমিহীন পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুধবার (৩ জুলাই) সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সামনে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটি, বারসিক এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্য রক্ষা টিম এই মানববন্ধনের আয়োজন করে।
মানব বন্ধনে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আবুল কালাম আজাদ উচ্ছেদ হওয়া পরিবার গুলোকে দ্রুত পুনর্বাসনে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, পরিবারগুলো পথে বসেছে। মানবেতন জীবন যাপন করছে। তাদের দুঃখকষ্ট দেখার মতো না। খোলা আকাশে বৃষ্টিতে ভিজে রাত কেটেছে তাদের। তাদের দ্রুত পুনর্বাসন করা দরকার। মানব বন্ধনে, সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক আজাদ হোসেন বেলাল বলেন, রাস্তা চার লেন হোক এটি আমার চাই। কিন্তু সড়ক বিভাগের যে জায়গায় দীর্ঘদিন পড়েছিলো সেখানে শতশত ভূমিহীন মানুষ বসবাস করতো। যাদের বাড়ি নেই, ভূমি নেই তারা সেখানে বসবাস করবে এটা স্বাভাবিক। তাদের কোন প্রকার পুনর্বাসন না করে তাদের এভাবে উচ্ছেদ করা উচিত হচ্ছে না। সাতক্ষীরা অনেক সরকারি খাস জমি আছে। সেখানে তাদের ব্যবস্থা করতো পারতো। তারা আগে থেকেই ভূমিহীন ছিলো। সরকারি জায়গায় বসবাস করতো। এই বৃষ্টির মধ্যে শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কোথায় যাবে। তারা আজ বাস্তুহারা হয়ে গেল। আমাদের দাবী এই মানুষগুলোর জায়গা দিয়ে পুনর্বসান করে তার উচ্ছেদ অভিযান শুরুকরা। ভূমিদস্যুরা হাজার হাজার সরকারি জায়গা দখল করে ধান ও মাছ চাষ করছে তাদের বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আমাদের দাবী ভূমিদস্যুরা বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হোক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, ভূমিদস্যুরা বাঁকালে অনেক সরকারি জায়গা দখল করে রেখেছে। এছাড়াও সরকারি অনেক খাস জমি আছে। সেখানে আমাদের জমি দেওয়া দাবী করছি। আমরাও চাইনি এভাবে রাস্তার পাশে বসবাস করতে। কিন্তু কি করবো জমি কিনে বাড়ি করার মতো ক্ষমতা আমাদের নেই। শুনলাম সাতক্ষীরাকে ভূমিহীন ও গৃহহীন ঘোষণা করা হয়েছে। তাহলে আমরা কি ভূমিহনী না। আমরা কী এদেশের মানুষ না। আমাদের কী কেউ খোজ নেবে না। ঘর ভাঙার পর থেকে প্রশাসনের কেউ আমাদের কোন খোঁজ নেইনি।
গতকাল ৩ জুলাই বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বসতভিটা হারিয়ে রাস্তার পাশে খোলা মাঠে পলিথিন টানিয়ে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে অসহায় পরিবারগুলো। প্রচন্ড বৃষ্টিতে সারারাত ছেলে-মেয়েকে নিয়ে নির্ঘুম রাত কেটেছে তাদের। সেই সাথে দেখা দিয়েছে খাবারের কষ্ট।
শ্যামনগরের নয়াবেশি এলাকার ছোটপুকুর এলাকা থেকে চলে আসা মাজিদা জানান, পরিবার ১৯৭৫ সাল থেকে পরিবার নিয়ে সড়কের পাশেই বসবাস করে আসছি। বিনা নোটিশে তাদের সেই ঘরবাড়ি সবই ভেঙ্গে দিল। এখন কি করবো বুঝতে পারছি না। একজন রোকনুজ্জামান। তিনি বলেন, সোমবার দুপুরে ভেঙে দেওয়ার পর অধিকাংশ মানুষ সেখান থেকে না খেয়ে দিন কাটিয়েছে। খাবে কী করে রান্না করার চুলা নেই। এখানে ৪জন প্রতিবন্ধী, চারজন বৃদ্ধসহ ১৫জন শিশু আছে। এখানে ৪০ পরিবারেরর নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীসহ ১৬০জন মানুষ বৃষ্টিতে ভিজে মানবেতার জীবন যাপন করছে। সরকারি ভাবে সাহায্য নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। তবে স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলর জামায়াতের আহম্মদ সাহেব প্রতিদিন খিচুড়ি রান্না করে আমাদের খেতে দিচ্ছে।
ইটাগাছা বস্তির জবেদা বেগম বিলাপ করতে করতে বলেন, বৃষ্টির দিনে প্রতিবন্ধী মেয়েদের নিয়ে কোথায় যাব? কোথায় থাকবো? কী হবে আমাদের? ভিক্ষা করে সংসার চালায়। দুই প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে খুপড়ি ঘর বেঁধে বহুবছর ধরে এখানে থাকি। স্বামী ছিল, সেও ছেড়ে চলে গেছে। যে ঘরটি ছিল তাও কেড়ে নিল। এখন যাব কোথায়? জবেদার মতো গৃহহীন হয়ে পড়েছে রোকেয়া, লিলি, জাহারানা, রিক্তাসহ অসংখ্য নারী প্রধান পরিবার। এদের কেউ স্বামী পরিত্যাক্তা, কেউবা বিধবা। জবেদার ঠিক পাশে ঘর থেকে জিনিসপত্র বের করে নিয়ে মাঠের ধারে নাতনিকে নিয়ে বসে ছিলেন জামের আলী। কান্নাজিড়ত কণ্ঠে তিনি বলেন, পথে বসে গেছি। এই ছোট বাচ্ছা নিয়ে কোথায় যাব জানি না। যা ছিল সব ভেঙে চুরে দেছে। সব শেষ। আল্লাহই জানে আমাদের কপালে এখন কী আছে।
যাওয়ার জায়গা থাকলে কী এই বৃষ্টিতে ভিজে এখানে পড়ে থাকতাম? যা আয় করি পরিবারের ৫জন সদ্যসের কোন রকম চলে। জমি কিনবো কীভাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূমিহীনদের জন্য জায়গাসহ ঘর দিয়েছেন। ওই ঘরের জন্য চেয়ারম্যান মেম্বারসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ঘুরেছি। কোন লাভ হয়নি। আজ আমাদের বাড়ি ঘর ভেঙে দিয়েছে। শুকনা মৌসুমে ভাঙতে পারতো। বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাবো, কোথায় গিয়ে থাকবো। খাদিজা নামে একজন বলেন, ঘর ভেঙে দেওয়ার কারণে আমাদের খুবই কষ্টের মধ্যে দিয়ে কেটেছে। পানি নেই, বাথরুম নেই। থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যাওয়ার জায়গা নেই।
অভিযোগ রয়েছে দখলদারদের নামে যারা সড়কের পাশে বসবাস করে তাদের বেশির ভাগই জায়গা জমি আছে। বাড়তি সুবিধা নেওয়ার জন্য তারা ভূমিহীন দাবী করছে। এছাড়া সড়কের পাশে বসবাস করতে রাজনৈতিক নেতাদের নিয়মিত চাঁদা দিতে হতো।
সাতক্ষীরা সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার পারভেজ বলেন, সাতক্ষীরা শহর থেকে ভেটখালী পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার সড়কের ধারের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। এর আগে বারবার মাইকিং করে এবং নোটিশের মাধ্যমে দখলদারদের স্থাপনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য বলা হলেও তারা তা সরিয়ে না নেওয়ায় এ উচ্ছেদ অভিযান শুরুকরা হয়েছে। তিনি বলেন, এরইমধ্যে শহর থেকে ভেটখালী পর্যন্তচার লেন সড়কের টেন্ডারও সম্পন্ন হয়েছে। সড়কের জায়গা উদ্ধারের পর বাকি কার্যক্রমও শুরু হবে।