ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ-সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার তিন আসামির জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন তাদের আইনজীবীরা। আসামিরা হলেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু, হত্যার মূল পরিকল্পনায় থাকা চরমপন্থি নেতা আমানুল্যা ওরফে শিমুল ভূঁইয়া ও তানভীর ভূঁইয়া। বৃহস্পতিবার ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুল হকের আদালতে এ আবেদন করা হয়।
আসামিদের উপস্থিতিতে তাদের পক্ষে শুনানি করেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সাবেক সরকারি কৌঁসুলি এহসানুল হক সমাজীসহ কয়েকজন আইনজীবী। শুনানি শেষে আদালত আবেদনগুলো নথিভুক্ত রাখার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে আসামিরা রিমান্ডে ‘নির্যাতনের কারণে অসুস্থ’ হয়ে পড়ার কথা বলে চিকিৎসার আবেদন করেন। বিচারক কারাবিধি অনুযায়ী কারা কর্তৃপক্ষকে চিকিৎসার নির্দেশ দেন।
আসামি বাবুর ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রত্যাহারের শুনানি শেষে তার আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী সাংবাদিকদের বলেন, জবানবন্দিতে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলানো হয়েছে। তদন্তাধীন কোনো মামলায় আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি জনসম্মুখে প্রকাশ করার একটা বাধা রয়েছে। কারণ এটা প্রাইভেট ডকুমেন্টস। এটা নিয়ে বক্তব্য দেওয়া ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। কী করে গণমাধ্যমে তাদের জবানবন্দি প্রকাশ পেল? তদন্তাধীন ‘স্পর্শকাতর’ বিষয়ে হুবহু বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশ বেআইনি বলেও দাবি করেন এ আইনজীবী।
তিনি আরও বলেন, জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদনটি এখন নথিতে থাকবে। এর গুরুত্ব তৈরি হবে- যখন আসামিপক্ষ ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় (আসামির পরীক্ষা) আত্মপক্ষ সমর্থনের দিন এ আবেদনের কারণ যথার্থতার মেলবন্ধন করতে পারেন। সেদিন যৌক্তিক মনে করলে বিচারিক আদালত এ আবেদনের বক্তব্য অর্থাৎ জোর করে নেওয়া জবানবন্দি আমলে নেবেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার সেলেস্তি রহমানের জামিন আবেদন করলে আদালত তা নামঞ্জুর করেন।
এমপি আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ মামলায় এখন পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তারা হলেন- শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর ভূঁইয়া, সেলেস্তি রহমান, ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু, জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু, মোস্তাফিজুর রহমান ও ফয়সাল আলী। তাদের মধ্যে মিন্টু ছাড়া ছয়জনই হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। বর্তমানে সব আসামি কারাগারে রয়েছেন।
তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ পেছাল: এমপি আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের মামলায় ৮ আগস্টের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদন দাখিলের দিন ছিল। কিন্তু তদন্ত সংস্থা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এ কারণে আদালত প্রতিবেদন দাখিলের নতুন দিন ঠিক করেন বলে জানান সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) জালাল উদ্দিন।
হত্যাকাণ্ডে নাম আসা অন্যদের গ্রেফতারে কাজ করছে ডিবি। বৃহস্পতিবার এক ভিডিও বার্তায় একথা বলেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, হত্যার ঘটনায় সর্বশেষ দুর্গম পাহাড়ে ফটিকছড়ির পাতাল কালীমন্দিরে অভিযান চালিয়ে মোস্তাফিজ ও ফয়সালকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, আক্তারুজ্জামান শাহীন তাদের ভারতে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট ও ভিসার ব্যবস্থা করে দেন।
হারুন অর রশীদ বলেন, ভিসা হওয়ার পর শাহীন ট্রেনে ভারতে যাওয়ার জন্য মোস্তাফিজ ও ফয়সালকে ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। ভারতে গিয়ে তারা ১০ এপ্রিল কলকাতার সঞ্জীবা গার্ডেনে প্রবেশ করেন। ১৩ মে বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাসা থেকে বেরিয়ে লাল গাড়িতে এমপি আনারকে সেখানে নিয়ে যান ফয়সাল। এরপর শাহীনের পিএস পিন্টুর কাছে থেকে সিয়ামের মাধ্যমে অচেতন করার জন্য ক্লোরোফর্ম, ধারালো চাপাতি ও চেয়ার নিয়ে আসার দায়িত্ব পালন করেন মোস্তাফিজ, ফয়সাল ও জিহাদ।
জিজ্ঞাসাবাদে মোস্তাফিজ ও ফয়সাল আরও বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের পর সর্বশেষ মোস্তাফিজ ও ফয়সাল সঞ্জীবা গার্ডেনের ওই ফ্ল্যাটে ছিলেন। তখন শাহীনের সঙ্গে কথা হয় তাদের। শাহীন তাদের বুঝিয়ে বলেন, ফ্ল্যাটটিতে যেন কোনো চুল ও রক্তের দাগ না থাকে, সবকিছু পাউডার দিয়ে ধুয়েমুছে গুছিয়ে ঠিকঠাকভাবে রাখতে হবে। কেননা এগুলো থাকলে সিআইডি পুলিশ এসে বুঝে ফেলবে এবং তারা বিপদে পড়বেন। এরপর ১৯ মে মোস্তাফিজ ও ফয়সাল বাংলাদেশে চলে আসেন। বাংলাদেশে আসার টিকিটও কেটে দেন শাহীন। দেশে এসে শাহীনের বসুন্ধরার মদের কারখানার বাসার তিনতলায় ওঠেন মোস্তাফিজ ও ফয়সাল।
তিনি বলেন, যেহেতু ১৯ মে রাতে শিমুল ভূঁইয়া ডিবির হাতে গ্রেফতার হন তখন তারা লাগেজ ফেলে দিয়ে শাহীনের দেওয়া ৩০ হাজার টাকা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করেন। আনার হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত সাতজন গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ছয়জনই ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এমপি আনার ১২ মে ভারতে যান। পরদিন ১৩ মে কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন তিনি। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে ২২ মে। ওইদিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় আনারের মেয়ে ডরিন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন। এছাড়া ভারতে একটি হত্যা মামলা হয়। দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে নয়জনকে গ্রেফতার করেছে। তারা হলেন বাংলাদেশে গ্রেফতার শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর, সেলেস্তি, ফয়সাল, মোস্তাফিজ, গ্যাস বাবু ও মিন্টু। ভারতে গ্রেফতার আছেন সিয়াম ও কসাই জাহিদ। এছাড়া আরও তিনজনের নাম এসেছে, যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত নয়। তারা হলেন, চেলসি চেরি ওরফে আরিয়া, তাজ মোহাম্মদ খান ও জামাল হোসেন। তবে আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে তারা ব্যবহৃত হতে পারে বলে ডিবির সন্দেহ।