নিয়াজ কওছার তুহিন/ ইব্রাহিম খলিল: ভোমরা স্থল বন্দর ও বসন্তপুর নৌ বন্দর খুলে দিতে পারে সাতক্ষীরার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। শুধু সাতক্ষীরা জেলার নয়, বন্দর দুটি সারাদেশের আমদানী-রপ্তানী বানিজ্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
কোলকাতা ও হলদিয়া বন্দরের খুব নিকটে সাতক্ষীরার বসন্তপুর নৌ বন্দর অবস্থিত। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধের কারণে বন্দরটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রারম্ভে ওই এলাকা দিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল ভারতে যাতায়াত করেছেন।
অপরদিকে ভোমরা থেকে কোলকাতার দুরুত্ব মাত্র ৭২ কি.মি.। এটাই বাংলাদেশে অবস্থিত কোলকাতার সবচেয়ে নিকটের স্থল বন্দর। তাছাড়া বেনাপোলের পন্যজট কমাতে ভোমরা স্থল বন্দর পূর্ণঙ্গভাবে চালু করার অন্য কোন বিকল্প নেই। একই সাথে পূর্ণাঙ্গ কাস্টমস হাউজ চালু করলে অধিকাংশ সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে।
দেশ স্বাধীনের পর থেকে ভোমরা ইমিগ্রেশন চেকপোষ্ট দিয়ে শুধুমাত্র দু’দেশের পাসপোর্ট যাত্রীরা আসা যাওয়া করতে পারতেন। ১৯৯৬ সালের ১৫ এপ্রিল বিশিষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ স ম আলাউদ্দিনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভোমরা বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার ১৭ বছর পর ২০১৫ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তৎকালীন নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ভোমরা বন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর হিসেবে ঘোষণা দেন। তারপরও চালু হয়নি পূর্ণাঙ্গ কাস্টমস হাউজ। নেই সব পণ্য আমদানি রপ্তানির অনুমতিও। বিশেষ করে উচ্চ রাজস্ব আসে এমন পন্য ভোমরা দিয়ে তেমন একটা আনতে দেওয়া হয়না। ফলে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা থাকার পরও দেশের অন্য বন্দরের তুলনায় পিছিয়ে আছে এই বন্দরটি।
সাতক্ষীরা জেলা শহর থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ভোমরা স্থলবন্দর। এই বন্দরের ওপারে ভারতের ঘোজাডাঙ্গা বন্দর। সেখান থেকে কলকাতার দূরত্ব মাত্র ৭২ কিলোমিটার। তবে কাস্টমস হাউজ চালু না হওয়ায় এখনও এই বন্দর দিয়ে সব পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারেন না ব্যবসায়ীরা। এছাড়া বন্দরটিতে নেই কোনো সরকারি ট্রাক টার্মিনাল, ফায়ার স্টেশন, হাসপাতাল ও পুলিশ ফাঁড়ি। কয়েক বছর আগেও এই বন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ আদা, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, আপেল, আঙুরসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি হতো। তবে বর্তমানে অন্য বন্দরের তুলনায় শুল্ক ছাড় কম থাকায় কমেছে ফল আমদানি। এছাড়া সকল পণ্য আমদানি-রপ্তানির সুযোগ না থাকায় বন্দর ব্যবহারে অগ্রহ হারাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে যেসব পণ্য ঢোকার অনুমতি রয়েছে, ভোমরা কাস্টমস হাউজ চালু না হওয়া ও আমদানিযোগ্য সকল পণ্যের অনুমতি প্রদান সমস্যার কারণে তার সবগুলো ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। একই সঙ্গে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এছাড়া ভোমরা বন্ধরের উপর নির্ভরশীল এ এলাকার প্রায় ৫০ হাজার পরিবার। কাস্টমস হাউজ চালু হলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটবে এবং হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী নেতারা।
সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর সিএন্ডএফ এজেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ খান জানান, কাস্টমস্ হাউজ প্রতিষ্ঠা হলে আমরা সকল ধরনের পণ্য আমদানির সুবিধা পাব। এছাড়াও ভোমরা স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষের শেড না থাকা ও কিপিং লাইসেন্স নেই। কিন্তু কাস্টমস্ হাউজ বাস্তবায়ন হলে এগুলো চলে আসবে। আমরা একজন কমিশনার পাব। আমাদের আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রমের জন্য আর খুলনায় যেতে হবে না। বর্তমানে এই বন্দরে সব ধরণের পণ্য আমদানির সুযোগ না থাকায় অনেক ব্যবসায়ি অন্য বন্দরে চলে যাচ্ছেন। কোলকাতা থেকে ভোমরার দূরত্ব কম। পদ্মা সেতু হয়ে খুবই উপকার হয়েছে ব্যবসায়ীদের। মাত্র ৫ থেকে ৬ঘন্টায় ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করা মালামাল দেশের যে কোন স্থানে পৌছে যাচ্ছে। তবে ভোমরা স্থলবন্দরে কাস্টমস হাউস না থাকায় ৭২টি পণ্যের অনুমোদন থাকলেও ২২ থেকে ২৫টি এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে। সব পণ্য আমদানি-রপ্তানি করাসম্ভব হচ্ছে না। ফলে একদিকে যেমন ব্যবসায়ীরা পদ্মা সেতুর পুরো সুফল পাচ্ছেন না, তেমনি সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক শেখ এজাজ আহমেদ স্বপন জানান, ভোমরা বন্দরের যে অবকাঠামো উন্নয়নগুলো বাকি রয়েছে সেগুলো জরুরী ভিত্তিতে শেষ করা এবং বিশেষ করে ট্রাক টার্মিনাল। এছাড়াও কাস্টম হাউজের ব্যাপারে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের সহযোগিতা কামনা করছি। ভোমরা ব্যবসায়ীদের দাবি একটাই কাস্টম হাউজ বাস্তবায়ন। পদ্মা সেতু হওয়ার পর সাতক্ষীরার অর্থনীতি আমূল বদলে গেছে। মানুষের যাতায়াতের সুবিধা হয়েছে। চাইলে তারা দিনের কাজ শেষ করে দিনে ফিরে আসতে পারছেন। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন। মাছ অক্সিজেনের মাধ্যমে ঢাকাসহ পাশের জেলায় যাচ্ছে। আমদানি করা পণ্য বিশেষ করে পচনশীল পেঁয়াজ, আদাসহ কাঁচামাল ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়াতে ভোমরা বন্দর ব্যবহার করে কলকাতা ও ঢাকার দূরত্ব কমেছে দ্বিগুণ। ফলে গুরুত্বপূর্ণ এ বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শেষে কাস্টমস হাউজ চালু হলেই পূর্ণাঙ্গ বন্দরে রূপ নিবে ভোমরা বন্দর। তখন সুযোগ সুবিধাও বাড়বে। এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটবে এমনটাই নয় সরকারও পাবে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। সাথে বাড়বে এই অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান।
অপরদিকে বসন্তপুর নৌ বন্দর চালু করা সম্পর্কে মথুরেশপুর ইউপি চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিম জানান, স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ১৯৬০ এর দশকেও বসন্তপুর নৌবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি রপ্তানি হতো। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধের কারণে বন্দরটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রারম্ভে ওই এলাকা দিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল হোসেন ও শেখ জামাল হোসেন ভারতে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের স্মৃতি বিজড়িত এ স্থানে আবারও নৌবন্দরটি চালু হলে আমদানি রপ্তানিতে অনেক সুবিধা হবে। মানুষের কর্ম সংস্থান সৃষ্টি হবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ সবদিক দিয়ে সুফল বয়ে আনবে। নদীপথে পণ্য আনা নেয়ার খরচ তুলনামূলক কম হয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন,
সার্বিক বিবেচনায় বসন্তপুর নদীবন্দর দ্রুত চালুর প্রত্যাশায় একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আন্তরিক প্রচেষ্টায় বসন্তপুর নদীবন্দর চালুর বিষয়টি অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের ১৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি বসন্তপুর নদীবন্দরের কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী মহোদয়ের আগমন বসন্তপুর নদীবন্দর দ্রুত চালুর ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।