আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি, উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়ছে সুন্দরবনে। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বনে সুন্দরী ও গরানসহ দশটি প্রধান গাছের চারা গজানোর হার কমে গেছে। এ ছাড়া লবণাক্ততা ও ছত্রাকের কারণে সুন্দরীগাছের আগা মরা, গেওয়া গাছের শেকড় পচন ও পশুর গাছের হার্ট রট বা ঢোর রোগ বেড়েছে। এ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বন বিভাগে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে রূপ বদলাচ্ছে সুন্দরবন। ইতোমধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ সুন্দরী গাছ, ৫০ শতাংশ পশুর গাছ ও ১০ শতাংশ গেওয়া গাছসহ ৬ প্রজাতির গাছ আক্রান্ত হয়েছে বিভিন্ন রোগে। বন গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, শ্বাসমূলের ওপর পলি পড়ে মারা যাচ্ছে অসংখ্য কেওড়া গাছ। পলি পড়ার কারণে গাছের শ্বাসমূল মাটির নিচে চলে যায় এবং গাছ রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বিশেষ করে বনের কটকা এলাকার কেওড়া বন পুরো বিলীন হওয়ার পথে। কটকা বন অফিসের পেছন পাশে বিশাল এলাকায় গেলে এ অবস্থা দেখা যাবে। আগে সেখানে হরিণের অবাধ বিচরণ ছিল, এখন সেখানে আর আগের মতো হরিণ দেখা যায় না।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে সুন্দরবনের আয়তন কমে যাওয়ার কিছু তথ্য প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯০৪ সালে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১১ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার। ১৯৬৭ সালে তা কমে হয় ১১ হাজার ৬৬৩ বর্গকিলোমিটার। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বনের আয়তন হয়েছে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন ১ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার কমে গেছে। সরেজমিনে সুন্দরবনের কালাবগি ফরেস্ট স্টেশনের ওয়াচ টাওয়ারের উপর উঠে এবং দক্ষিণ দিকের খালে গিয়ে চারিদিকে আগামরা অসংখ্য সুন্দরী গাছ দেখা গেছে। প্রায়ই একই রকম চিত্র দেখা গেছে বানিয়াখালি ও বজবজা এলাকাতেও। কালাবগি ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা মো. আবদুল হাকিম বলেন, আগামরা রোগে কিছু কিছু সুন্দরী গাছ মারা যাচ্ছে। আবার নতুন চারাও গজাচ্ছে।
বন গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, রোগাক্রান্ত সুন্দরী গাছ ফল-বীজ ধারণ করছে কম এবং চারার পরিমাণও কমে গেছে। ৩৩টি স্থায়ী নমুনা প্লটে গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরী গাছের চারার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। আগে যেখানে চারা ও বড় গাছের পরিমাণ বেশি ছিল সেখানেও কমে গেছে। হার্ট রট রোগে আক্রান্তপশুর গাছেরও বীজ ও চারা কম হচ্ছে। পশুর গাছের অনেক চারা, ফল, পাতা ও বীজ হরিণ খেয়ে ফেলে। এদিকে বন গবেষণা ইন্সটিটিউট ২০২২ সালের নভেম্বরে ‘ইকোলজিক্যাল মনিটরিং থ্রোা এস্টাবলিশমেন্ট অব পার্মানেন্ট স্যাম্পল প্লটস ইন দ্যা সুন্দরবন’ শিরোনামে একটি স্টাডি করে। ওই স্টাডিতে ৩৩টি স্থায়ী নমুনা প্লট থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি হেক্টরে গড়ে ৩৮ হাজার ৭৯২টি চারা জন্মায়। এর মধ্যে সুন্দরী গাছের চারা ১০ দশমিক ০৫ শতাংশ। সংস্থাটির ২০০৯ সালের গবেষণার তথ্য বলছে, ওই বছর সুন্দরী গাছের চারা গজানোর হার ছিল ৩৫ দশমিক ৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনে বনভূমি প্রায় ৭০ ভাগ; জলাভূমি ৩০ ভাগ। বনের ৬৪ শতাংশ গাছই সুন্দরী। এ ছাড়া গেওয়া ১৬ শতাংশ, পশুর ১ শতাংশ, বাইন ২ শতাংশ, গরান ৩ শতাংশ ও কেওড়া গাছ ১ শতাংশ। বনের প্রায় ৪০ ভাগ সুন্দরী আগা মরা রোগ এবং ৫০ ভাগ পশুর হার্ট রট বা ঢোর রোগে আক্রান্তহয়েছে। অধিক লবণাক্ত এলাকায় বয়স্ক সুন্দরী গাছ বেশি আক্রাš Íহচ্ছে। অধিক ও মৃদু লবণাক্ত উভয় এলাকাতেই পশুর গাছ ঢোর রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ঢোর রোগে আক্রান্তগাছের বাকল ঠিক থাকে, তবে ভেতরের কাঠ পচে যায়। সুন্দরবনে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে ৯ বছরের ব্যবধানে দশটি গাছের চারা গজানোর হার কমেছে। ২০১০ সালে গড়ে প্রতি হেক্টরে সুন্দরীগাছের চারা গজিয়েছিল পাঁচ হাজার ৫৫৬টি। ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় চার হাজার ১৯২টিতে। ২০১০ সালে গড়ে প্রতি হেক্টরে গরানগাছের চারা গজিয়েছিল ৯ হাজার ৫৫৬টি। ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৪৯৫টিতে।
পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপিল্গনের অধ্যাপক ড. আবদুলল্গাহ হারুন চৌধুরী বলেন, হিরণ পয়েন্টে বিশ্ব-ঐতিহ্যের নামফলকের বিপরীত পাশে অনেক এলাকায় নতুন করে চারা গজাচ্ছে না। কারণ সেখানকার মাটিতে চারা গজানোর সক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। সুন্দরবন বন সংরক্ষক খুলনা অঞ্চল মিহির কুমার দে জানান, বনের পশ্চিম অংশে গাছের আগামরা রোগের প্রবণতা ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে বনের নির্দিষ্ট অংশের বাইরে এই রোগ দেখা যায়নি। তবে কটকা কচিখালিতে তৃণভূমিতে গাছ কিছুটা কমেছে।