আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা : উজাড় হচ্ছে উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনী। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে। অবৈধভাবে সংরক্ষিত বনগুলো থেকে গাছ কর্তন, অগ্নিসংযোগ, দখল, বালু উত্তোলন, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন কারণে উজাড় হচ্ছে উপকূলের সবুজ বেষ্টনী। এতে বাংলাদেশের মানচিত্র পরিবর্তন হয়ে যাবে। উপকূলে সবুজায়নের দায়িত্ব বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের হলেও মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা এবং দায়িত্বহীনতার কারণে উপকূলজুড়ে যতটুকু সবুজ বেষ্টনী রয়েছে, তা বনখোকো ও ভূমিদস্যুরা সাবাড় করে দিচ্ছে। বনবিভাগ, পুলিশ, জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে। বলা যায়, রক্ষকই ভক্ষকে পরিণত হয়েছে। সাধারণত উপকূলীয় তটরেখা বরাবর শতকরা ৮০ ভাগ সবুজ বেষ্টনী থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে স্থানভেদে রয়েছে ২০ থেকে ৩০ ভাগ। অন্যদিকে, দেশে মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনাঞ্চল থাকা অপরিহার্য হলেও রয়েছে মাত্র ৮ থেকে ১০ ভাগ। এ এক ভয়াবহ চিত্র। উপকূলের বনাঞ্চলের এমন শোচনীয় অবস্থায় শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত করলে কী ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। এমত তথ্য দিচ্ছে বিশেজ্ঞরা। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর জেলার ১৯টি উপকূলীয় উপজেলায় ১ হাজার ১৪৯ কিলোমিটার এলাকায় নন ম্যানগ্রোভ গাছের বনায়ণ কর্মসূচির আওতায় ২০১৬ সালের জুলাই থেকে সবুজ বেষ্টনী তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। ২২ কোটি ৯২ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২০ সালের জুন মেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সবুজ বেষ্টনী তৈরি, ভূমিহীন দরিদ্রদের পুনর্বাসন, দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি, ভূমিক্ষয় ও জীববৈচিত্র্য হ্রাস করার কথা থাকলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ফলে ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল বসবাস সঙ্কটের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
সরেজমিনে ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত তিন দশকে দেশের উপকূলভাগে ৫০ ভাগেরও বেশি সুশোভিত কেওড়া-বাইন-ঝাউবন, প্যারাবন, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল উজাড় হয়ে গেছে। এর নেপথ্যে বনখেকো এবং ভূমিদস্যু চক্র তৎপর। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই নাম ব্যবহার করেই ওরা প্রভাব খাটায়। বনবিভাগ, পুলিশ, জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই উপকূলের মানচিত্র পাল্টে দিচ্ছে এসব চক্র। দৈনিক কোটি কোটি টাকা হাতবদল করছে। সবুজ বেষ্টনীর প্রতিনিয়ত ঘটছে সর্বনাশ। বিরান হয়ে যাচ্ছে দুর্যোগে সুরক্ষায় প্রাকৃতিক ঢাল। ক্রমাগত বন উজাড় ও নিধনের কারণে বর্তমানে স্থানভেদে মাত্র ২০ থেকে ৩০ ভাগ কোনোমতে টিকে আছে। অবশিষ্ট উপকূলীয় বনাঞ্চলও সঙ্কটাপন্ন। ভিটেমাটি ও চাষের জমি হারাচ্ছে উপকূলবাসী।
টিআইবি জানায়, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে বার্ষিক বন উজাড় হওয়ার হার বৈশ্বিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ, ২ দশমিক ৬ শতাংশ। গত সতেরো বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৬৬ বর্গকিলোমিটার গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেইন ফরেস্ট ধ্বংস করা হয়েছে, যা উদ্বেগের। আর বন বিভাগের হিসেবে সারাদেশে দখল হয়ে গেছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৫৩ একর বনভূমি। এরমধ্যে ১ লাখ ৩৮ হাজার একর সংরক্ষিত বনভূমি। পরিবেশবিদরা বলছে, মাঠের বাস্তবতায় যা ঘটছে, উপকূলে যত বনায়ন হচ্ছে, ততই চলছে ধ্বংসযজ্ঞ। এটাই যেন ‘নিয়মে’ পরিণত হয়েছে। নেই তদারকি, সঠিক মনিটরিং। স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার বালাই নেই। উপকূলজুড়ে বনায়ন কর্মসূচি সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। কিন্তু তাকে পুঁজি করে, আসল উদ্দেশ্যকে ভিন্ন খাতে ব্যবহারের মাধ্যমে চলছে বনায়নে লুটপাট।
এদিকে “সুস্থ পরিবেশ স্মার্ট বাংলাদেশ” এই স্লোগানকে সামনে রেখে পরিবেশ অধিদপ্তর সাতক্ষীরা জেলার উদ্যোগে সোমবার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে পরিবেশ অধিদপ্তর সাতক্ষীরা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল ইসলাম, জেলা ভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম, জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি রনি প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রির জিএম নাজমুস সাকিব, বিসিক শিল্পনগরী সাতক্ষীরার গানিম এক ব্লক এয়ার লিমিটেড এর পরিচালক মুবাশশীরুল ইসলামসহ সাতক্ষীরার বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বেশি করে বিভিন্ন প্রকার গাছ লাগানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মুহা: হুমায়ুন কবির বলেন, সাতক্ষীরাসহ সমগ্র উপকূলে সবুজ বেষ্টনী গড়তে সরকার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা সহকারে উপকূল-বান্ধব ব্যাপক বনায়ন এবং তার সুরক্ষার উপায় নিশ্চিত করা হলে সমুদ্র উপকূলে ভূমিক্ষয় রোধ, নতুন করে চর ও ভূমি জাগিয়ে তোলা সম্ভব হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের কবল থেকে দেশের সমৃদ্ধ উপকূলকে সুরক্ষা করা যাবে। এর পাশাপাশি সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনাসমূহকে কাজে লাগানোর পথ হবে সুগম।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী জানান, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে দেশ রক্ষা পেতে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী উপকূলীয় এলাকায় ৫শ মিটার সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হবে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তখন ওই এলাকায় খাদ্য উৎপাদন হবে না। লবণাক্ততা ঢাকার কাছে চলে আসবে। এতে বাংলাদেশের মানচিত্র পরিবর্তন হয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি করেছে। বেশি গাছ থাকলে তাপমাত্রা কম হবে। তাই বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে বেশি বেশি করে গাছ লাগাতে হবে।