সরকারি চাকরিতে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত) কোটা পদ্ধতি সংক্রান্ত বিষয়বস্তুর ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দিয়ে আগামী ৭ই আগস্ট পর্যন্ত সব পক্ষকে এ স্থিতাবস্থা মেনে চলতে নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। গত বৃহস্পতিবার মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের মূল অংশ প্রকাশ করেছে। রায়ে বলা হয়েছে সরকার প্রয়োজনে কোটা পদ্ধতির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে এবং কোটা পূরণ না হলে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে পারবে।
শুক্রবারও কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীরা তাদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। রাজধানী ঢাকার শাহবাগে এক ঘণ্টারও বেশি সময় অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছেন। ঢাকার বাইরেও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন। আন্দোলনকারীদের দাবি বিদ্যমান ৫৬ শতাংশ কোটার সংস্কার চান। সরকার চাইলে সংসদে আইন পাস করে দ্রুত তাদের দাবি মেনে নিতে পারেন বলে তারা মনে করেন।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ও আইনজ্ঞরা একমত প্রকাশ করেছেন। আইনজ্ঞরা মনে করেন, সরকার চাইলে সংসদে আইন পাস করেও কোটা সংস্কার করে কোটা বিরোধী আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটাতে পারে। আদালতেরও সেই সুযোগ রয়েছে। একমত প্রকাশ করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এমএ মতিন।
তিনি মানবজমিনকে বলেন, কোটার বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে সমাধান হওয়া উচিত। যেহেতু তারা রাস্তায় আছে। তাদের দাবিটা মেনে নিয়ে সরকার কোটা সংস্কার করে সংসদে একটি বিশেষ আইন পাস করতে পারে। এ ছাড়া বিষয়টি সুরাহার জন্য যে কেউ আপিল বিভাগে পক্ষভুক্ত হয়ে মেনশন করতে পারেন। এক্ষেত্রে সরকার পক্ষও (রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল) মেনশন করতে পারেন। আপিল বিভাগও বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি করতে পারেন।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট এডভোকেট ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ মানবজমিনকে বলেন, কোটা বিরোধী আন্দোলনটাকে সরকারের গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত সমাধান করা উচিত। সরকার কোটা সংস্কার করে সংসদে একটি আইন পাস করতে পারে। রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে কাল রোববার সিপি ফাইল করতে পারেন। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য আপিল বিভাগে মেনশন করতে পারেন। আদালত বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে শুনানির উদ্যোগ নিতে পারেন। এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট কিংবা আইনে কোনো বাধা নেই।
মনজিল মোরসেদ বলেন, সংবিধানে সরাসরি কোটার কথা বলা নেই। তবে অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকে সুযোগ দিতে সরকারকে পলিসি ম্যাটারের অধিকার দিয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় সিরিয়াস মুভমেন্ট করছে। এটা কিন্তু কোনো দলীয় মুভমেন্ট নয়। তাদের দাবির যৌক্তিকতা আছে। তাদের দাবি মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হোক। আসলে দেশ সমাজের উন্নয়ন করতে হলে মেধার কোনো বিকল্প নেই। তাই মেধাকে গুরুত্ব দিতেই হবে। অনেকদিন ধরে তো এই সুযোগ দেয়া হয়েছে। এখন কোটার সংস্কার করা যেতে পারে। যেখানে ৩০% আছে সেখানে ৫% করেন। তাছাড়া বর্তমানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, নাতি-নাতনির সংখ্যা অনেক।
সাবেক জেলা জজ ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহজাহান সাজু মানবজমিনকে বলেন, দেশ চালায় নির্বাহী বিভাগ। সরকার যেকোনো সময় কোটা সংস্কার করে একটি পরিপত্র জারি করতে পারে। এতে সুপ্রিম কোর্টের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। ইচ্ছা করলে সরকার আইন পাস করেও বিষয়টি সমাধান করতে পারেন। তিনি কোটা বিরোধী আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটাতে সরকার দুটি উদ্যোগ নিতে পারে বলে মনে করেন। ১. সরকার কোটা সংস্কার করে যে কোনো সময় নতুন একটি পরিপত্র জারি করতে পারে। এটা বৃহস্পতিবার হাইকোর্টও তার রায়ে বলে দিয়েছেন, সরকার চাইলে কোটা পরিবর্তন করতে পারবে। এতে সুপ্রিম কোর্টের কোনো বাধা নেই। ২. রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল কাল রোববার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আপিল বিভাগে মেনশন করতে পারেন। আপিল বিভাগ যেকোনো দিন শুনানির উদ্যোগ নিতে পারে।
ড. শাহজাহান সাজু বলেন, একচুয়ালি কোটা নিয়ে সংবিধানে কিছু বলা নেই। ১০% কোটা থাকবে, না ৩০% কোটা থাকবে। সংবিধানের আর্টিকেল ১৯-এ বলা আছে, সকল নাগরিকের সমান সুযোগ থাকবে। আর ২৯-এ বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে। তবে অনগ্রসর বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলধারার সঙ্গে যুক্ত করতে কোটা থাকতে পারে।
ড. সাজু বলেন, বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের দুরবস্থা দূর করার লক্ষ্যে চাকরির ক্ষেত্রে কোটার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। সে সময় সেটা যৌক্তিক ছিল। তখন মুক্তিযোদ্ধারা অর্থনৈতিকভাবে নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন। তাদের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৫২/৫৩ বছরে এসে এখনো ৩০% কোটা সৃষ্টি করা যুক্তিসঙ্গত নয়। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়িয়ে দিতে পারে। বাৎসরিক প্রণোদনা দিতে পারে। প্রণোদনা এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকাও হতে পারে। প্রয়োজনে সরকার তাদের ঘরবাড়ি বানিয়ে দিতে পারে। আরও অনেক কিছুই করতে পারে। কিন্তু সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মেধার গুরুত্ব দেয়াটাই সঠিক হবে। তা না হলে মেধাবীদের প্রতি বৈষম্য করা হবে। রাষ্ট্র তো বৈষম্য করতে পারে না। তিনি আরও বলেন, কোটা ব্যবস্থার কারণে অনেক মেধাবীরা আজ চাকরি পাচ্ছে না। এটা কন্টিনিউ করলে তো দেশ এগিয়ে যাবে না। দেশকে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থেই কোটা পদ্ধতির সংস্কার করা দরকার। বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে কোটা কতটুকু থাকবে, তাও নির্ধারণ করা যেতে পারে। যারা রাস্তায় আছেন তারা অনেক মেধাবী। তাদের অনেকেই আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জানে। নানা বিষয়ে পড়াশোনা করে। তাদের দাবিকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, দেশে এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে যারা ভাতা নেন না। অনেকে সার্টিফিকেটও নেননি। তারা বলেন, আমরা সার্টিফিকেটের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি।