নিজস্ব প্রতিনিধি: দীর্ঘদিন যাবত চিকিৎসক সংকটের কারণে চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে। বছরের পর বছর ধরে ৯টি গুরত্বপুর্ন চিকিৎসকের পদ শুন্য রয়েছে জেলা সদরের ১০০শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতালটিতে। রয়েছে নার্সসহ অন্যান্য জনবল সংকটও।
এতে করে জেলার দুর্দুরন্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারন মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। তারা সরকারি খরচে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে ক্লিনিকমুখি হচ্ছেন। এতে তাদের চিকিৎসা ব্যয়ও বাড়ছে।
অন্যদিকে সদর হাসপাতালের চিকিৎসকসহ অন্যান্য জনবল সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন জানান শুন্য পদের অনুকুলে জনবল চেয়ে একাধিকবার সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পত্র প্রেরণ করেও কোনো লাভ হয়নি।
জেলার উপকুলীয় আশাশুনি উপজেলার নাকতাড়া গ্রামের জবেদ আলী মোড়ল (৬৫) সদর হাসপাতালে এসেছিলেন চোখের চিকিৎসা নিতে। তিনি বলেন, ৫০ থেকে ৫৫ মাইল পথ অতিক্রম করে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে এসেই জানতে পারেন এখানে কোনো চক্ষু চিকিৎসক নেই। বাড়ি থেকে জেলা সদরে আশা যাওয়া খরচ কমপক্ষে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। যা পুরো খরচটাই বৃথা হয়েছে বলে জানান এই বৃদ্ধ চক্ষুরোগী। তিনি বলেন, বেসরকারী পর্যায়ে কোনো ক্লিনিক বা হাসপাতালে চক্ষু পরিক্ষা-নিরিক্ষা করার মতো আর্থিক সামর্থ তার নেই। তাই চিকিৎসা না করেই বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন তিনি।
সদর উপজেলার আগড়দাড়ী গ্রামের মোমিন আলী জানান, সদর হাসাপাতালে এসেছিলেন বার্ধক্য বিষয়ে মেডিসিন ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু বহির্বিভাগের কাউন্টার সামনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট নেয়ার পর জানতে পারেন সদর হাসপাতালে দীর্ঘদিন মেডিসিন ডাক্তার নেই। তিনি বলেন, বাড়ি থেকে জানতে পারলে এই কষ্ট করে আসতেন না। স্থানীয় বা গ্রাম পর্যায়ের চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ নিতেন।
শুধু জবেদ আলী বা মোমিন আলী সরদারই নয় প্রতিদিন শতশত মানুষ তাদের কাক্সিক্ষত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন এই হাসপাতাল থেকে।
সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসারের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ৫০ শয্যা বিশিষ্ট সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল নির্মান করা হয় ১৯৮০ সালে। শুরু থেকে রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় পরবর্তীতে ২০১০ সালের দিকে হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নতি করা হয়। সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলার কমপক্ষে ২২ লাখ মানুষের একটি বড় অংশ চিকিৎসা সেবা প্রত্যাশা করেন এই হাসপাতালে। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত জেলা সদরের এই গুরত্বপূর্ণ হাসপাতালটিতে চলছে তীব্র চিকিৎসক সংকট। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাক্তার ফয়সাল আহমেদ জানান, এই হাসাপাতালে ২৭জন চিকিৎসকের মধ্যে গুরত্বপূর্ণ ৯টি চিকিৎসকের পদ শুন্য রয়েছে দুই থেকে আড়াই বছর। এসব শুন্য পদ হচ্ছে সিনিয়র কনসালটেন্ট সার্জারি, সিনিয়র কনসালটেন্ট মেডিসিন, সিনিয়র কনসালটেন্ট গাইনী, সিনিয়র কনসালটেন্ট চক্ষু, সিনিয়র কনসালটেন্ট এ্যানেসথেসিয়া, জুনিয়র কনসালটেন্ট সার্জারি, মেডিকেল অফিসার ও রেডিওলজিস্ট। এছাড়া ৪জন সিনিয়র নার্সের পদও শুন্য রয়েছে। এছাড়া হাসাপাতালের অন্যান্য কর্মচারীর পদ শুন্য রয়েছে ১৯টি। এরমধ্যে ৩য় শ্রেণির কর্মচারী ১৩টি এবং ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীর ৬টি পদ শুন্য রয়েছে। ডাক্তার ফয়সাল আহমেদ আরও বলেন, চিকিৎসকসহ এসব শুন্য পদে জনবল চেয়ে সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে একাধিকবার পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত শুন্য পদের অনুকুলে কোনো জনবল পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সাতক্ষীরা সভাপতি হেনরি সরদার বলেন, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করাসহ সঠিক সময়ে চিকিৎসকদের হাসপাতালে উপস্থিতির বিষয় নিয়ে টিআইবি‘র পক্ষ থেকে অনেক বারই চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্ত তাতে কোনো লাভ হয়নি। প্রতিনিয়ত সাধারন মানুষ তাদের কাক্সিক্ষত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাধ্য হয়ে মানুষ ক্লিনিকমুখি হচ্ছেন। ফলে সরকারী খরচে চিকিৎসা নিতে পারছেন না তারা। তবে টিআইবি’র পক্ষ থেকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতল নিয়ে একটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশের জন্য ঢাকা প্রধান কার্যলয় পত্র পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডাক্তার মো. আব্দুস সালাম চিকিৎসকসহ অন্যান্য জনবল সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, শুন্য পদে ৯জন চিকিৎসক, ৪জন নার্স এবং অন্যন্য শুন্য পদে জনবল চেয়ে একাধিকবার স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালকের দপ্তরে পত্র প্রেরণ করা হলেও অদ্যাবধি কোনো লাভ হয়নি। তিনি বলেন, নিয়মিত শতাধিক ভর্তি রোগীসহ বহির্বিভাগে প্রচুর পরিমান রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। কিন্তু চিকিৎসক স্বল্পতার কারণে তাদেরকে কাক্সিক্ষক চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। তার পরও চেষ্টা করা হচ্ছে সাধারন মানুষ যেন চিকিৎসা নিতে এসে ফিরে না যায়।
সাতক্ষীরা সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য লায়লা পারভীন সেঁজুতি বলেন, সদর হাসাপাতালে গাইনী বিষেশজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নারীরা খুবই দুর্ভোগে পড়ছেন। একই ভাবে হয়রানীর শিকার হচ্ছে চোখের রোগীও। জেলা সদরের সরকারী হাসাপাতালের সবচেয়ে গুরত্বপুর্ন ৯জন চিকিৎসকই নেই। এটা অত্যান্ত দুঃখজনক। দ্রুত যাতে চিকিৎসকসহ অন্যান্য জনবল নিয়োগ হয় সে ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তিনি চেষ্টা করবেন বলে জানান।
সদর হাসপাতাল ব্যবস্থপনা কমিটির সভাপতি সাতক্ষীরা সদর আসনের সংসদ সদস্য আশরাফুজ্জামান আশু বলেন, অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল বর্তমান তীব্র জনবল সংকটে রয়েছে। জরুরীভাবে জনবল নিয়োগের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে। এরপরও যে পরিমান চিকিৎসক ও অন্যান্য জনবল আছে তারা যেন সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন করে সে ব্যাপারে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
Check Also
সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান
নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। …