কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে দুর্নীতির টাকা ফেরত দিচ্ছে সাতক্ষীরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর

ক্রাইমবাতা রিপোট, সাতক্ষীরাঃ চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে দুর্নীতির টাকা ফেরত দিচ্ছে সাতক্ষীরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। আন্দোলনের মুখে প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া লাখ লাখ টাকা ফেরত দিচ্ছে সাতক্ষীরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উচ্চমান সহকারী(ইডি) মোস্তফা জামান শেখ। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অধীনে যানবাহন চালনা প্রশিক্ষণ কোর্সের প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য বরাদ্দের প্রায় অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এই ইডিমোস্তফা জামান সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। এছাড়াও প্রশিক্ষণার্থীদের ভর্তির সময় উৎকোচ হিসেবে বিভিন্ন অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, যানবাহন চালনা কোর্সে ভর্তির পর যানবাহন চালানোর লাইসেন্স নির্বিঘেœ পেতে বিআরটিএ-কে ম্যানেজ করাসহ বিভিন্ন অযুহাতে প্রশীক্ষণার্থীরে জন্য সরকার প্রদত্ত যাতায়াত ভাতাসহ বিভিন্ন খাতের টাকাও হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সরকার যুবকদের কাজে লাগাতে ২০১৭ সালে যুবনীতি ঘোষণা করে। এ নীতিমালায় দেশের ৪২শতাংশ যুবকদের বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষে আত্মকর্মসংস্থান, সামাজিক বৈষম্য, বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলায় কাজে লাগানোসহ য্বু সমাজকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে কাজ করছে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রতি বছর ১৮ বছর থেকে ৩৫ বছর বয়সের যুবদের বিভিন্ন কোর্সে প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষিতদের মাঝে ঋণ দিয়ে তাদেরকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাতক্ষীরাতে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সাতটি উপজেলার চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ শেষে ৬৭৯ জন যুবকদের মাঝে ঋণ প্রদান করেছে। এসব যুবদের মাঝে সর্বনিম্ন চল্লিশ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত যুব ঋণ দেওয়া হয়েছে। চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে ২ কোটি ৩০ লাখ ৫০হাজার টাকা যুব ঋণ দেওয়া হয়। আত্মকর্মস্থানে প্রদত্ত ঋণ আদায়ের হার ৯৩ শতাংশ এবং পরিবার কর্মসূচিতে ৯৮ শতাংশ। এসব ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সরকারের গৃহীত এসব কার্যক্রম বেকারত্ব যুবকদের মাজে তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি বলে ভুক্তভোগীরা জানান।

সম্প্রতি এমন ধরনের বিভিন্ন অভিযোগ তুলে সাতক্ষীরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অধীনে যানবাহন চালনা প্রশিক্ষণ কোর্সের বিভিন্ন ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থীরা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগে বলা হয়, প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি ভাতার ৬হাজার টাকা দেওয়ার নামে খাতায় স্বাক্ষর করিয়েপ্র শিক্ষণার্থীদের হাতে টাকা দিয়ে ছবি তুলে তা পুনরায় ফেরত নেন সাতক্ষীরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উচ্চমান সহকারী মোস্তফা জামান শেখ। এছাড়া প্রতি ব্যাচে ২ থেকে ৩জন প্রশিক্ষণার্থী আবাসিক সুবিধা নিলেও খাতা কলমে তা বেশি দেখিয়ে সরকারি আবাসিক খাতের টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। এছাড়া নির্বাচিত প্রশিক্ষণার্থী হওয়া সঙ্গেও প্রশিক্ষণ শুরুর দুই-একদিন পূর্বে প্রশিক্ষণার্থীদের কাছে ফোন করে বিভিন্ন সমস্যা দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ দাবি ও আদায় করা হয়। এছাড়া অনলাইনে আবেদন ও লার্নারসহ প্রশিক্ষণার্থী প্রতি ১হাজার ১ শত ৫০টাকা করে নেওয়া হয়। এছাড়া প্রশিক্ষণার্থীদের যানবাহন চালনা প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দকৃত জ্বালানী খরচ বাঁচিয়ে সেখান থেকে টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। ফলে প্রশিক্ষণার্থীরা যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ নিতে পারছেন ন।

সরেজমিনে সাতক্ষীরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে দের জানা গেছে, বিগত ২০২২সালের নভেম্বর মাস থেকে প্রকল্পভিত্তিক ব্যাচ প্রতি এক মাস মেয়াদী যানবাহন চালনা প্রশিক্ষণ কোর্স শুরু হয়। যার প্রত্যেক ব্যাচে ৪০জন প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আসছেন। বর্তমানে জুলাই মাসে ২১তম ব্যাচ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, সাতক্ষীরা যুব উন্নয়নের অধীনে ১ম থেকে ১৪তম ব্যাচ পর্যন্ত প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য সরকারিভাবে প্রশিক্ষণার্থী প্রতি (আবাসিক) ৭ হাজার টাকা এবং (অনাবাসিক) ৪ হাজার ৫শ টাকা বরাদ্দ হয়। এছাড়া পরবর্তী ব্যাচে প্র শিক্ষণার্থী প্রতি (আবাসিক) ৯ হাজার টাকা এবং (অনাবাসিক) ৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে খুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সাতক্ষীরার অধীনে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সকল চালকদের দাবি ইতোপূর্বে খুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে তাদের কোন টাকা দেওয়া হয়নি, বরং তাদেরকে বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে বাড়তি টাকা আদায় করা হয়েছে।

প্রশিক্ষণার্থীদের অভিযোগ মতে (অনাবাসিক হিসেবে) ১ম থেকে ১৪তম ব্যাচের মোট ৫৬০ জন প্রশিক্ষণার্থীর বান্য বরাদ্দের ২৫ লক্ষ ২০ হাজার টাকা এবং পরবর্তী ১৫ম থেকে ২০তম ব্যাচ পর্যন্ত ২৪০ জন প্রশিক্ষণার্থীর বরাদ্দের ১৪লক্ষ ৪০ হাজার টাকা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সাতক্ষীরার উচ্চমান সহকারী (ইডি) মোস্তফা জামান শেখ বিভিন্ন কৌশলে ও বিভিন্ন অযুহাত এবং বিভিন্ন দপ্তর ম্যানেজ করার নামে সমুদয় টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া ১ থেকে ২০তম ব্যাচের মোট ৮০০ প্রশিক্ষণার্থীদের থেকে লার্নার বাবদ জন প্রতি ১১৫০ টাকা (মোট ৯ লক্ষ ২০ হাজার ) টাকা বাড়তি আদায় করে আত্মসাৎ করেছেন। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সাতক্ষীরার অধীনে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত চালক কলারোয়া উপজেলার কয়লা গ্রামের মো. মুরাদ হোসেন জানান, ‘তিনি ১৪তম ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন। ওই ব্যাচের প্রত্যেকের কাছ থেকে লার্নার বাবদ অতিরিক্ত ১১৫০ টাকা নেওয়া হয়েছিল’। তিনি আরও জানান, ‘আমাদের জন প্রতি ৪ হাজার ৫শ টাকা সরকারি তাতা বাবদ বরাদ্দ ছিল। কিন্তু বিআরটিএ ম্যানেজ করার নামে আমাদেরকে টাকা গ্রহণের খাতায় স্বাক্ষর করিয়ে সেই টাকা আমাদের হাতে দিয়ে ছবি তুলে নেয়। পরে সেই টাকা উচ্চমান সহকারী মোস্তফা জামান, প্রশিক্ষক আকুল এবং প্রশিক্ষক আজাদ আমাদের কাছ থেকে ফিরিয়ে নেয়’। মুরাদ হোসেন আরো জানান, ‘ওই টাকা তাদেরকে ফেরত না দিলে লাইসেন্স না দেওয়ার হুমকি দেয়। এজন্য সে সময়ে আমরা কিছুই বলতে পারিনি। পরে আমাদের জন্য সরকারি বরাদ্দের জন প্রতি আরো ২ হাজার ৫শ টাকা আসে। গত ১৫ জুলাই আমাদেরকে যুব উন্নয়নে ডাকা হয়। সেখানে আমাদের জন্য জন প্রতি বরাদ্দের ২হাজার ৫শ’ টাকার মধ্যে প্রত্যেককে ১হাজার টাকা করে দিতে চাইলে আমরা তা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে পুরো টাকা দাবি করি। তখন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত চালকদের তোপের মুখে উপ-পরিচালকের অফিসে বসে আমাদের সেই টাকা ফেরত দেন ইডি মোস্তফা জামান শেখ’। এসব ঘটনা সামনে আসার পর একের পর এক মুখ খুলতে থাকেন অন্যান্য ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থীরা। সামনে আসে একই ঘটনার অতীত ইতিহাস। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সাতক্ষীরার অধীনে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত চালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ‘তিনি ১১তম ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন। তাদের ব্যাচের প্রত্যেকের থেকে লার্নার করার নামে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়। এছাড়া সরকারি বরাদ্দের টাকা তারা পাননি’। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত চালক আশিকুর রহমান, জাকির হোসেন, বিদ্যুৎ সরকারও একই অভিযোগ জানান।
সাতক্ষীরা যুব উন্নয়নের অধীনে ১৫তম ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থী হাফিজুর রহমান জানান, তাদের জন্য সরকারী বরাদ্দ ছিল জনপ্রিতি ১৫ হাজার টাকা। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের হাতে দেওয়া হয় ১৫০০ টাকা। পরে প্রশিক্ষণার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রত্যেককে ৩০০০ টাকা করে ফেরত দেয়।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর সাতক্ষীরার উপ-পরিচালক (ডিডি) সঞ্জীত কুমার দাস বলেন, ‘আমি সম্প্রতি যোগদান করেছি। এ বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।

 

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।