কোটা আন্দোলন নিজের দেশে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে না বাঁচার জন্য : নির্মাতা ফারুকী

# মানুষকে ভয় দেখিয়ে, নিপীড়ন করে সাময়িকভাবে দমন করা যায়, কিন্তু তার বুকের ক্ষত মোচন করা যায় না: আসিফ নজরুল
# হাজারো মানুষের রক্তে রঞ্জিত এ আন্দোলন আপামর জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ
কোটা আন্দোলনের পথেই মুক্তি

ছাত্রদের সর্বশেষ বৈষম্য রিরোধী কোটা আন্দোলন যে শুধু চাকরির জন্য, সেটি মনে করছে না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কোটা আন্দোলনের আড়ালে অনেক বঞ্চনার চাপা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে আছে। অনেক কষ্টে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা থাকার জায়গা পান না, মানসম্মত খাবার পান না, লাইব্রেরিতে বই পান না, বসে পড়ার জন্য একটা টুল পান না। না খেয়ে সাত সকালে লাইন দিতে হয় লাইব্রেরিতে ঢোকার জন্য। পদে পদে বঞ্চনা আর বৈষম্যের শিকার হতে হয় তাঁদের।

চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সঠিকভাবেই তাঁর ফেসবুক দেয়ালে লিখেছিলেন, ‘আপনারা যাঁরা ভাবছেন আন্দোলনটা গ্রেফ একটা চাকরির জন্য, তাঁরা বোকার স্বর্গে আছেন। আপনারা এর সব কটি স্লোগান খেয়াল করেন। দেখবেন, এই আন্দোলন নাগরিকের সমমর্যাদার জন্য। এই আন্দোলন নিজের দেশে তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে না বাঁচার জন্য। এই আন্দোলন রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা আছেন, তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে, দেশের মালিক তাঁরা নন, আসল মালিক জনগণ। সেই জনগণকে রাষ্ট্র যে পাত্তা দেয় না, এই আন্দোলন সেটার বিরুদ্ধেও একটা বার্তা। রাষ্ট্র জনগণকে কেন পাত্তা দেয় না, এই আন্দোলনকারীরা সেটাও বোঝে। যে কারণে ভোটের বিষয়টাও স্লোগান আকারে শুনেছি। আমি এটাকে এইভাবেই পাঠ করছি।’

লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা তার কলমে লিখিছেন,“মনে পড়ছে তিউনিসিয়ার ঘটনা। রোজকার মতো সেদিনও রাজধানী তিউনিসে রুটির দোকানে একটি রুটি কিনতে এসেছিলেন দিন আনা দিন খাওয়া এক মানুষ। হঠাৎ বেড়ে যাওয়া দাম তাঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না। দোকানির সঙ্গে এ নিয়ে শুরু হয় বচসা, তারপর চেঁচামেচি, হইচই। মেজাজ হারিয়ে দুই ঘা বসিয়ে দেন দোকানি।
রুটি কিনতে আসা অভুক্ত সেই গরিব ক্রেতা মাটিতে পড়ে যান। আর উঠতে পারেননি। সেখানেই জান হারান তিনি। এ রকম পরিণতির জন্য কেউই প্রস্ত—ুত ছিল না। উপস্থিত পথচারী, মজা দেখতে দাঁড়িয়ে যাওয়া সবাই নিজেদের মধ্যে সেই অতিরিক্ত দাম দিতে অক্ষম গরিব ক্রেতাকে খুঁজে পান। তাঁরা মনে করতে থাকেন, রাস্তায় লুটিয়ে পড়া ক্রেতার লাশটা যেন তাঁদেরই লাশ।
জনতার কাছে বাড়তি দাম চাওয়া রুটির দোকানটা জনতার কাছে হয়ে ওঠে স্বৈরাচার সরকারের প্রতিভূ। দোকানদার পালিয়ে বাঁচলেও জনতার দেওয়া আগুনে পুড়ে যায় রুটির দোকান। রুটি কিনতে আসা লোকটির লাশ নিয়ে বের হওয়া মিছিলে নারী-পুরুষের ঢল নামে। জানাজায় শরিক হয় লাখ লাখ মানুষ। জানাজা হয়, দাফন হয়, কিন্তু ক্ষোভের আর দাফন হয় না, বরং তা বাড়তে থাকে। সহিংস থেকে সহিংসতর হতে থাকে সেই জনরোষ।
ক্ষমতাসীনেরা ভাবলেন, রুটির দাম নিয়েই যখন সূত্রপাত, তখন রুটির দাম কমিয়ে দাও। কিন্তু দেখা গেল, রুটির দাম কমিয়ে মানুষের ক্ষোভের আগুন নেভানো গেল না। বরং তা আরও জ্বলে উঠল। জনবিচ্ছিন্ন শাসকেরা রুটিটাই দেখেছিল; আর মানুষ রুটির মধ্যে দেখেছিল ঝলসানো দেশ। তারা দেখেছিল, দুর্নীতি আর দেশের অর্থসম্পদ পাচারের সুবিধাভোগী ও মদদদাতাদের হাতে দেশ নামের রুটিটি ঝলসে গেছে। রুটিওয়ালার ফাঁসি বা সব রুটির দোকানির লাইসেন্স বাতিল ক্ষিপ্ত মিছিলের প্রাথমিক দাবি থাকলেও তা আর সেখানে আটকে থাকেনি। বিরতিহীন সেই আন্দোলনের স্রোতোধারা দেশের সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষকে ভয় দেখিয়ে, নিপীড়ন করে সাময়িকভাবে দমন করা যায়, কিন্তু তার বুকের ক্ষত মোচন করা যায় না। মানুষের বুকে রয়েছে রংপুরের আবু সাঈদের বুকে পুলিশের গুলি চালিয়ে হত্যার মতো বহু দৃশ্য, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের লাঠিপেটা, রক্তাক্ত ও লাঞ্ছিত করার বহু টুকরা স্মৃতি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগকে নামানোর প্রকাশ্য নির্দেশ। সন্তানসম শত শত ছাত্র এবং হাজারো মানুষের রক্তে রঞ্জিত এ আন্দোলন আপামর জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কি না, এতে দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি, নিপীড়নে অতিষ্ঠ মানুষের ক্ষোভও যুক্ত হয়েছে কি না, সরকারকে তা নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। অযথা রাজনৈতিক হয়রানি বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এবারের আন্দোলনের পরিধি ও বিস্তৃতি অনেক ব্যাপক। সরকারি স্থাপনায় নাশকতার জন্য তদন্তের আগেই ঢালাওভাবে বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের দায়ী করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তা ছাড়া প্রচারমাধ্যম এবং টেলিযোগাযোগের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের পরও বিএনপি জামায়াত কেউ নাশকতার নির্দেশ দিয়েছে, এমন একটি প্রমাণ সরকার উপস্থাপন করতে পারেনি। এখন পুলিশের গ্রেপ্তারের পর কারও মুখ দিয়ে এ ধরনের স্বীকারোক্তি প্রচার করলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা কীভাবে থাকবে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, গত বছর ২৮ অক্টোবর লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড হামলার পর যে বিএনপি পালিয়ে মাঠ ছেড়েছে, কী জাদুবলে তারা হঠাৎ সারা দেশে নাশকতার শক্তি অর্জন করেছে, তা নিয়ে মানুষের প্রশ্ন থাকবে। সরকারকে এসব বুঝতে হবে।

ছাত্রলীগ পরিচয়ে অস্ত্রধারীদের তান্ডব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের নির্বিচার মারধর ও লাঞ্ছিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার অসংখ্য বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর শক্তি প্রয়োগে আন্দোলন দমনের কৌশল অনুসরণের কথাটি স্মরণে রেখে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নাগরিকরা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক ড. শাহদীন মালিক তার কলামে লিখেছেন, কর্তৃত্ববাদী বা প্রায় একনায়কতন্ত্রী সরকারের বৈশিষ্ট্য হলো, তারা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক সরকার শক্তি প্রয়োগের বদলে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার পথ বেছে নেয়। অস্বীকার্যভাবে আমরা এখন কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীন বসবাস করছি। সরকার যদি সমঝোতার পথে আসতে চায়, তাহলে প্রথমেই পুলিশের গুলিতে রংপুরের আবু সাঈদের মৃত্যু মৃত্যু থেকে শুরু করে দুইশতাধীকের উপরে মৃত্য এবং আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের ধরে নিয়ে যে অত্যাচার করা হয়েছে, অবিলম্বে তার তদন্ত করে বিচার হতে হবে।

নির্বাচন বিশ্লেষক ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমার মতে, আবু সাঈদকে সরাসরি হত্যা করা হয়েছে। একটি নয়, বেশ কয়েকটি গুলিতে (রাবার বুলেটে) তাঁর বুক ও মাথা ঝাঁঝরা হয়েছে। ‘আবু সাঈদের মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তের ওই ছবি বহু যুগ ন্যায্য দাবির পক্ষে দাঁড়ানো ছাত্র আন্দোলনের প্রতীক হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।’

প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক আনিসুল হক তার কলামে লিখেছেন, ২০২৪-এর জুলাইয়ে যা ঘটল, তা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এত মৃত্যু এর আগে কোনো আন্দোলনে ঘটেনি। বাবার কোলে শিশু মারা গেছে, ঘরের জানালা বন্ধ করতে গিয়ে মারা গেছে বাচ্চা ছেলে। এত রাবার বুলেট, এত কাঁদানে গ্যাসের শেল, এত সাউন্ড গ্রেনেড, এত গুলি আর কোনো সময়ে ছোড়া হয়েছে বলে আমাদের মনে পড়ে না। আন্দোলন দমনে বা পুলিশ উদ্ধারে হেলিকপ্টারের ব্যবহার এর আগে হয়েছিল কি? সারা দেশে একযোগে এত মানুষ রাস্তায় নেমেছিল কি না, সেটাও আমাদের স্মৃতিতে নেই। সবাই বলছেন, এর মূলে আছে মানুষের বহুবিধ ক্ষোভ। জিনিসপত্রের দাম বেশি, মূল্যস্ফীতি লাগামহীন। একটার পর একটা দুর্নীতির খবর আসতে লাগল, এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজে বললেন, তাঁর পিয়ন চার শকোটি টাকার মালিক। নির্বাচন হয়েছে নামমাত্র, বিরোধী দলবিহীন। মানুষ কথা বলতে ভয় পায়, ফেসবুকে কিছু বললেই নেমে আসে সাইবার সিকিউরিটি। এলাকায় এলাকায় ক্ষমতাসীন নেতা, পাতিনেতাদের দৌরাত্ম্য। একদিকে ব্যাংক খালি করা হচ্ছে, আরেক দিকে টাকা পাচারে দেশ শীর্ষ তালিকায় উঠে গেছে।

বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী তার কলামে লিখেছেন, মজলুমের দোয়া কখনো ব্যর্থ হয় না। আল্লাহ ন্যায়বিচারক। তিনি ইনসাফ করেন। জুলুম পছন্দ করেন না। জুলুমের কারণে পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে, শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। পরিণতিতে একসময় জালিম বা অন্যায়কারীর জীবনে নেমে আসে নানা আজাব। ‘জালিমরা কখনো সফল হয় না।’ তাই মজলুমের অশ্রু ও অভিশাপ জালিমের পতনের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল তার কলামে লিখেছেন, মানুষকে ভয় দেখিয়ে, নিপীড়ন করে সাময়িকভাবে দমন করা যায়, কিন্তু তার বুকের ক্ষত মোচন করা যায় না। মানুষের বুকে রয়েছে রংপুরের আবু সাঈদের বুকে পুলিশের গুলি চালিয়ে হত্যার মতো বহু দৃশ্য, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের লাঠিপেটা, রক্তাক্ত ও লাঞ্ছিত করার বহু টুকরা স্মৃতি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগকে নামানোর প্রকাশ্য নির্দেশ। করে দেয়। মানুষের স্মৃতিতে বুলেটের ক্ষত, মানুষের বুকে অবিচার, বঞ্চনা, স্বজন আর সহপাঠী হারানোর ক্ষত। একতরফা প্রচারণা আর নিপীড়ন চালিয়ে এ ক্ষত মোচন করা যাবে না।

বিশেজ্ঞরা বলেছেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারকে আলাপ-আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধানের পথ ধরতে হবে; সেনাসদস্যদের নামিয়ে, ইন্টারনেট বন্ধ রেখে, হাজার হাজার লোকের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে এই সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং সমস্যাটা আরও ঘনীভূত হবে। আমাদের জীবন এমনিই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সবার নাভিশ্বাস। এগুলোর সবকিছুকে আমলে নিয়ে সবার সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করে সরকারকে একটা সমাধানের পথে যেতে হবে। দেশের অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ যখন ব্যাপক, তখন সরকার এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করবে না, যাতে সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো একই কাতারে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়। এসব ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো, নাকি সরকার বড় একটি ভুল করল, তা বলার সময় এখনো আসেনি। কিন্তু সরকারের ভূমিকায় যে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে, তা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে।

(এই রিপোটে যে সব কলামের কথা বলা হয়েছে তা দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত কলাম থেকে নেওয়া)।

 

Check Also

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করেননি সমাজী

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে আন্তর্জাতিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।