আপনজনের খোঁজে ভিড় আদালত প্রাঙ্গণে

নাছির উদ্দিন শোয়েব : আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদকে তুলে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই দিন রাজধানীতে পুলিশ হত্যার অভিযোগের মামলায় ছাত্রদল নেতাসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে দ্যা মিরর এশিয়া নিউজের সাংবাদিক সাঈদ খানকে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে এভাবে প্রতিদিনই বাড়ছে গ্রেফতার। আর স্বজনদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ-আতঙ্ক।

তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে-সহিংসতায় জড়িতদেরকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। ঘটনার পর ভিডিও ফুটেজ দেখে চিহ্নি করে গ্রেফতার করা হচ্ছে। তবে স্বজনদের অভিযোগ- বিনা অপরাধে পুলিশ শুধু সন্দেহবশত এদের আটক করে নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে গত ছয় দিনে তিন শতাধিক মামলায় পাঁচ সহস্রাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। পুলিশ বলছে, ঢাকাসহ সারাদেশে সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে ২০৯টি। এসব মামলায় এ পর্যন্ত ২৩৫৭ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। অভিযোগ রয়েছে, গ্রেফতার অনেকের খোঁজও মিলছে না। তাদের খোঁজে প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছে সিএমএম কোর্ট প্রাঙ্গণে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ঢালাওভাবে মামলা ও গ্রেপ্তার বন্ধের দাবি জানিয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিও জানিয়েছে সংস্থাটি। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এসব দাবি জানায় সুজন। বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার সংস্কারের লক্ষ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের জের ধরে সৃষ্ট অচলাবস্থা এখনও নিরসন হয়নি। সহিংতায় মৃত্যুর সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই চলেছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিহতের সংখ্যা দু’শ ছাড়িয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়া, স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ফলে এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে বলে আমরা মনে করি। এতে দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। কোনো স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে এত প্রাণহানি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। প্রত্যেকটি প্রাণই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কিছুর বিনিময়ে তা পূরণ হবার নয়।

জানা গেছে, কয়েকদিন ধরে গ্রেফতার ব্যক্তিদের খোঁজে সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন স্বজনরা। কয়েকজন আইনজীবী জানান, সরকার ক্ষমতার বাড়াবাড়ি করছে। ঢালাও গ্রেফতার করছে কর্মীদের। আর পাবলিক প্রসিকিউটরের দাবি, তথ্য ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। কেউ নির্দোষ হলে সেটি আদালতেই প্রমাণ হবে। আদালতে আসামীবাহী গাড়ি দেখা মাত্রই ছুটে আসছেন স্বজনরা। গ্রেফতার স্বজনের খোঁজে কেউ কেউ ডাক দিচ্ছেন নাম ধরে। কেউ কেউ খুবই চিন্তিত। বহু ডাকাডাকির পরও সাড়া মেলে না স্বজনের। জানান, থানায় যোগাযোগ করলে পুলিশ জানিয়েছিল, আদালতে নেয়া হচ্ছে। সেখানেই দেখা পাওয়া যাবে। অনেকে দাবি করেন, আন্দোলনে জড়িত না থাকলেও আপনজনকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে গোয়েন্দা পুলিশ। কারও অভিযোগ, শুধু বিএনপি করার কারণেই হতে হয়েছে গ্রেফতার। তবে ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর জানান, সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ হাতে নিয়ে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না।

গতকাল শুক্রবারও সাপ্তাাহিক ছুটির দিনেও আদালত চত্ত্বরে ভিড় করছেন আটকদের স্বজনরা। এসময় আটক ব্যক্তিদের নির্দোষ দাবি করে বিনা অপরাধে গ্রেফতারের অভিযোগ করেন তাদের স্বজনরা। ঢাকার চিফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চত্ত্বর ঘুরে দেখা গেছে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার ব্যক্তিদের স্বজনদের ভিড়। কারও মা-বাবা, কারও ভাই কারও বোন কিংবা অন্যান্য আত্বীয়রা অপেক্ষা করছেন। তাদের অনেকে আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করছেন। তাদের মধ্যে বুধবার রাত ৩টায় গ্রেফতার হন রাজধানীর সাইনবোর্ডের বাসিন্দা তুষার। তিনি পেশায় একজন রাজমিস্ত্রী। দুপুরে আদালত চত্ত্বরে তুষারের মা মমতাজ বেগম ছেলেকে দেখার জন্য ঢাকার চিফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট চত্বরের অপেক্ষা করেন। এসময় তিনি বলেন, আমার ছেলে তুষারের বয়স ২১ কিংবা ২২ হবে। সে রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। তাকে রাত ৩টায় ডেমরা থানার পুলিশ এসে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে। আমি জানি না আমার ছেলে কি করছে। গত কয়েকদিনের আন্দোলনেও যায়নি। ১২টার দিকে আদালতে ছেলের জন্য এসেছি। সে গাড়ি থেকে আমাকে দেখেই মা মা বলে চিৎকার করছিল।

রাজধানীর কাজলা সামাদ নগরের বাসিন্দা মনির হোসেন। বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় দিকে তুলে নিয়ে যায় যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। মনির হোসেনের স্ত্রী ছালমা বলেন, গতকাল (বৃহস্পতিবার) আমার স্বামী দোকান বন্ধ করে বাসায় এসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। হঠাৎ পুলিশ এসে বাসায় ঢুকে যায়। এরপর কিছু না বলেই হ্যান্ডকাফ পরাতে গেলে আমি জিজ্ঞেস করি, কেন আমার স্বামীকে গ্রেফতার করবেন? কী অপরাধ? এরপর হ্যান্ডকাফ দিয়ে আমার হাতে পুলিশ আঘাত করে। এসময় আমার ছোট্ট ছেলে এসে বাধা দিলে তাকে টেনে সরিয়ে দিয়ে আমার স্বামীকে নিয়ে চলে যায়। এসময় তারা আমাদের বাসার নিচের সব সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলে। এসময় সঙ্গে থাকা আটক মনির হোসেনের মা জানান, ছেলেকে দেখতে এসেছি। এই আন্দোলনে সে কখনো রাস্তায় বের হয়নি। এক সময় বিএনপি সমর্থন করত। এখন সে কোনো দল করে না। এভাবে দুপুর থেকে আদালত চত্ত্বরে অনেক স্বজন আটকদের নির্দোষ দাবি করে প্রতিবাদ করেন। এসময় তারা বিনা অপরাধে গ্রেফতারের অভিযোগ করেন। গ্রেফতার হওয়া দ্যা মিরর এশিয়া নিউজের সাংবাদিক সাঈদ খানের স্ত্রী সানজিদা ইতি বলেন, ‘আমার স্বামীকে নিউজ করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে। মেট্টোরেলে হামলার অভিযোগ করা হয়েছে। তিনি সাংবাদিক নিউজতো করবেই। আমার স্বামী দেশের জন্য কাজ করছে। এছাড়াও আন্দোলনে তার পায়ে ইট পড়ায় কয়েকদিন ভালোভাবে কাজ করতে পারেনি। আমি কখনো আদালতে আসিনি। আমার অসুস্থ ছেলেটা বাবার জন্য কেঁদে কেঁদে অস্থির। আপনারা প্লিজ আমার ছেলের জন্য তার বাবাকে ফিরিয়ে দিন।

ঢাকায়  গ্রেফতার ২৩৫৭ : কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে ঢাকাসহ সারাদেশে সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর, সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে ২০৯টি। এসব মামলায় এ পর্যন্ত ২৩৫৭ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এদের বেশিরভাগ বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী। গতকাল শুক্রবার ডিএমপির যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (অপারেশনস) বিপ্লব কুমার সরকার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, সহিংসতা নাশকতার ঘটনায় গোয়েন্দা তথ্য ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ২০৯টি মামলায় ২৩৫৭ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এদিকে ঢাকায় ৬৩ ও ঢাকার বাইরে ২০৩ জনসহ মোট ২৬৬ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। র‌্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান খান এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, নাশকতার অভিযোগে গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ৬৩ জন ও ঢাকার বাইরে ২০৩ জনসহ সারাদেশে ২৬৬ জন গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বিটিভি ভবন, মেট্রোরেলসহ রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় জড়িত অভিযোগে গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম সদস্য সচিব মো. তারেক রহমানসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। রাজধানীর মিরপুর ও বাড্ডা এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে র‌্যাব। তারা হলেন, গণঅধিকার পরিষদের যুগ্মা সদস্য সচিব মো. তারেক রহমান (৩১) ও তার সহযোগী মো. সজল মিয়া (২৪), আল ফয়সাল রকি (২৭) ও মো. আরিফুল ইসলাম (৩০)। অন্যদিকে গতকাল নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, যারা পুলিশকে হত্যা করেছে, সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে, স্বপ্নের মেট্রোরেলসহ সরকারি স্থাপনায় নাশকতা চালিয়েছে। যারা এসবের নেতৃত্ব দিয়েছে, অর্থ আদান-প্রদান করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। তারা যেখানেই থাকুক না কেন তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।