বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক বিনিয়োগকারী নিয়মিত কার্যক্রম শুরু করতে চাইলেও অনিশ্চয়তা বোধ করছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি জাভেদ আখতার। তিনি বলেন, একটি নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
এফআইসিসিআই মনে করে, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক ‘শাটডাউনে’ দেশের অর্থনীতিতে আনুমানিক ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু এফএমসিজি বা দ্রুত বিক্রি হয়, এমন পণ্যের ব্যবসাসংশ্লিষ্ট শিল্পে ১০ কোটি ডলারের বেশি ক্ষতি হয়েছে। সংগঠনটি বলেছে, সরবরাহব্যবস্থা ও পরিচালন উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হওয়ায় ব্যবসায়ের ক্ষতি হয়েছে।
আজ রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কার্যালয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা তুলে ধরেন ফরেন চেম্বারের সভাপতি জাভেদ আখতার।
সভায় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক এবং এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলমসহ বিভিন্ন খাতের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
জাভেদ আখতার একই সঙ্গে ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, শাটডাউনে রপ্তানিমুখী শিল্প, ব্যাংক, বিমা, সরবরাহ, অবকাঠামো, টেলিকম, ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং, রাইড-হেইলিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, সোশ্যাল কমার্সের ওপর নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠানসহ অনেক ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এফআইসিসিআই সভাপতি জানান, ইন্টারনেট সম্পূর্ণভাবে ফিরে না আসায় তারা শিল্পের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ কাজে লাগাতে পারছেন। এ ছাড়া বন্দর থেকে পণ্য খালাস ও শাটডাউনের সময় কাজ করতে না পারায় অতিরিক্ত বিলম্ব শুল্ক পরিশোধের দায় তৈরি হওয়াসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন তাঁরা।
বিনিয়োগকারীরা অস্তিত্বসংকটে
জাভেদ আখতার বলেন, দেশে বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরা অস্তিত্বসংকটের সম্মুখীন রয়েছেন। অথচ এই বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরাই হচ্ছেন দেশি–বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই আকর্ষণের সবচেয়ে শক্তিশালী অনুঘটক। এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যবসা সহজীকরণকে অগ্রাধিকার দিতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশকে সম্ভাব্য বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে বিবেচনায় রাখতে অন্যরা নিরুৎসাহিত হবেন।
জাভেদ আখতার বলেন, ‘ব্যবসায়িক কার্যক্রম মসৃণ করে ও ব্যবসা সহজীকরণকে উন্নত করে বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনর্নির্মাণ করতে হবে। অন্যথায় আমরা এফডিআই আকর্ষণে পিছিয়ে পরতে পারি।’ সাম্প্রতিক ঘটনায় দেশের রেটিং নিম্নমুখী হয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের আস্থাও ফিরিয়ে আনতে হবে। তা না করা গেলে দেশের ভাবমূর্তি আরও নেতিবাচক হবে।
দেশের উন্নয়ন ১০ বছর পিছিয়েছে
চলমান সামাজিক অস্থিরতায় দেশের উন্নয়নযাত্রাকে অন্তত ১০ বছর পিছিয়ে দিয়েছে বলে মনে করে ফরেন চেম্বার। সংগঠনটির সভাপতি বলেন, ‘আমরা রানা প্লাজা বিপর্যয় ও পরবর্তী সন্ত্রাসী হামলার বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে উঠতে ১০ বছর সময় পার করেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমরা সেই আগের জায়গায় ফিরে এসেছি।’
যেসব পরামর্শ দেওয়া হয়েছে
বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার। এর মধ্যে রয়েছে কারফিউ প্রত্যাহার ও স্বাভাবিক কার্যক্রম পুনরায় চালু করা; অবিলম্বে ব্রডব্যান্ড সংযোগ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং এফএমসিজিসহ অন্তত ২১টি খাতের জন্য মোবাইল ডেটার সম্পূর্ণ সংযোগ পুনরায় চালু করা।
এ ছাড়া স্থানীয় ও বিদেশি (বাংলাদেশে কর্মরত) কর্মীদের মধ্যে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ব্যাপারে আস্থা ফিরিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ মানুষ পূর্ণ নিরাপত্তায় চলাচল ও পরিবহন করতে পারলে ব্যবসায় গতি আসবে বলে মনে করে ফরেন চেম্বার।
অন্যান্য পরামর্শের মধ্যে রয়েছে—যেহেতু বন্দর থেকে পণ্য খালাস ও বাইরে দ্রুত শিপমেন্ট করা নিয়ে সমস্যা রয়েছে, তাই ১৮ জুলাই থেকে খালাস না পাওয়া সব পণ্যের জন্য বিলম্ব শুল্ক মওকুফ করা; একই উৎস থেকে নিয়মিত আমদানি করা হয়, এমন উপকরণের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ল্যাব পরীক্ষা বাদ দেওয়া; ব্যাংক ও কাস্টম হাউসের পরিচালনার সময় সমন্বয় করা প্রভৃতি।
ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জাভেদ আখতার জানান, আর্থিক প্রভাবের বাইরে দেশ যে ভাবমূর্তি–সংকটের মুখে পড়েছে, তা পরিমাপ করা যায় না। দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে এই ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে নানা পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।