সাতক্ষীরায় আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সংশয়

এসএম শহীদুল ইসলাম: দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টি থাকার পর অবশেষে বুধবার দেখা মিলেছে বৃষ্টির। তবে এবার আষাঢ়-শ্রাবণে অঝর ধারায় ঝরেনি বৃষ্টি। আকাশ মেঘলা থাকলেও হয়নি কাক্সিক্ষত বৃষ্টি। ফলে অনাবৃষ্টির কারণে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় আমন চাষ করতে সমস্যায় পড়েছেন প্রায় চার লক্ষাধিক কৃষক। এবার মৌসুমি বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় আমন ধানের বীজতলাও তৈরি করতে পারছেন না অধিকাংশ কৃষক। মাঝেমধ্যে সামান্য বৃষ্টি হলেও তা কোনো কাজে আসছে না। এরই মধ্যে শেষ হতে চলেছে বীজতলা প্রস্তুত করার সময়। এ অবস্থায় চলতি মৌসুমে আমন চাষ ও উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কায় চাষীরা। আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারবে কীনা তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।
কৃষি, আবহাওয়া ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাতক্ষীরাসহ আশপাশের জেলায় বৃষ্টিপাত কমেছে। অনাবৃষ্টির পাশাপাশি অস্বাভাবিক তাপমাত্রাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ধুলিহর এলাকার কৃষক আব্দুল মজিদ, ফারুক হোসেন, কবিরুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলামসহ তারা প্রতি মৌসুমে একেকজন ১০-১৫বিঘা জমিতে আমন চাষ করেন। তবে এবার তেমন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কেউ-ই বীজতলা তৈরি করতে পারেননি। অথচ চলতি মৌসুমে আমনের বীজতলা করার সময় প্রায় এক মাস অতিবাহিত হতে যাচ্ছে। ফিংড়ি ইউনিয়নের গোবরদাড়ি গ্রামের দেলওয়ার হোসেন, বালিথা গ্রামের শিক্ষক কনক কুমার ঘোষ জানান, তারা প্রত্যেকে ৪/৫বিঘা জমিতে আমন চাষ করেন। এ বছর কাক্সিক্ষত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় তিনি স্যালোমেশিনের সাহায্যে সেচ প্রক্রিয়ায় বীজতলা তৈরি করেছিলেন। অর্ধেক জমি রোপন করেছেন। বাকী অর্ধেক রোপনে বৃষ্টির অপেক্ষায় রয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে সেচে আগ্রহ হারিয়েছেন তিনি।
কৃষকরা জানান, গেল মৌসুমে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে পরবর্তী সময়ে ভূ-গর্ভের পানি উত্তোলন করে আমনের বীজতলা করেন। এতে করে তাদের উৎপাদন খরচ যেমন বেশি হয়েছিল, তেমনি সময়মতো ধান রোপন করতে না পেরে উৎপাদনও কম হয়েছিল। শুধু চলতি মৌসুমেই নয়, এমন অবস্থা তিন-চার বছর ধরে চলছে। একই কথা বলেন, ভালুকা চাঁদপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল মাজেদ। তিনি জানান, তার এলাকার হাজিখালি, আমোদখালি, বুড়ামারা, খড়িলের বিল, পালিচাঁদ, চেলারবিলসহ শতাধিক বিলের আমন চাষযোগ্য কয়েক হাজার বিঘা জমি শুকিয়ে আছে। বৃষ্টির অভাবে এসব জমিতে আমনের বীজতলা করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে মৌসুমও চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কৃষক সংশয়ে রয়েছেন।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন বলেন, চলতি বর্ষা মৌসুমে সাতক্ষীরায় জুন মাসে ৫৪ মিমি এবং জুলাই মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত ৩১৪ মিমি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, গত বছর জুন মাসে ২৯২ মিমি এবং জুলাই মাসে ২২৯ মিমি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল।
মৌসুমি বৃষ্টি না হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, জলবায়ু আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন বলেন, ‘আষাঢ় ও শ্রাবণে বিরামহীন বৃষ্টি হওয়ার কথা। আকাশে মেঘমালা তৈরি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু মেঘ তাৎক্ষণিক সরে যাচ্ছে অন্যত্র।’
বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়ার কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর সাতক্ষীরা জেলার সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত না হওয়ার যেসব কারণ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় এটির বেশি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একসময় দেশে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা থাকতো রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে। শীত ছিল পঞ্চগড় বা শ্রীমঙ্গলে। এখন সেটির প্রভাব চুয়াডাঙ্গায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এবার সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় এবং শীতের তীব্রতাও ছিল এখানে। চুয়াডাঙ্গার কাছাকাছি জেলা যশোর বা সাতক্ষীরা। এখানেও তার প্রভাব পড়া শুরু হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনেরও অন্যতম কারণ পর্যাপ্ত গাছ না থাকা, জলাশয় ভরাট হওয়া। গাছ কমে যাওয়ায় বায়ুম-লে কার্বন-ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেনের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এতে করে অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বাড়ছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় বৃষ্টি হচ্ছে না। প্রতি বছর বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগও। এ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে বেশি বেশি করে গাছ লাগানো, উন্মুক্ত জলাশয় ও পুকুর খনন করা।’
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘চলতি মৌসুমে জেলায় আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৮ হাজার ৭৭০ হেক্টর জমিতে, যা গত মৌসুমে ছিল ৭৮ হাজার ৬৮ হেক্টর জমি। তবে মৌসুমি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় অধিকাংশ কৃষক এখনো বীজতলা করতে পারেনি।’ তিনি কৃষককে জমি চাষ করে রাখার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। যাতে বৃষ্টি হলেই মাটি ধরে রাখতে পারে।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।