সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় গত রোববার তৃতীয় দফায় বিক্ষোভকারীদের হামলার পর আত্মসমর্পণ করতে চেয়েছিলেন কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় যে যাঁর মতো দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন কর্তব্যরত প্রায় ৪০ জন পুলিশ সদস্য। তাঁদের কেউ থানার ছাদে, কেউ পাশের বাড়িতে, কেউ শৌচাগারে, কেউবা জঙ্গলে আশ্রয় নেন। সেখান থেকেই খুঁজে এনে একে একে ১৪ জনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসীর কাছে অপরিচিত হামলাকারীরা।
হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া পুলিশ সদস্য ও এনায়েতপুর থানার আশপাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র পাওয়া গেছে। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, শাহাজাদপুর ও চৌহালী উপজেলার সীমান্তবর্তী কিছু এলাকা নিয়ে এনায়েতপুর থানা গঠিত। সিরাজগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে চৌহালী উপজেলার শেষ সীমানায় এ থানার অবস্থান।
হামলার ঘটনায় আহত হয়ে সিরাজগঞ্জের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন থানার পুলিশ পরিদর্শক শাহিনুর আলম। গতকাল সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোববার বেলা সাড়ে ১০টার দিকে প্রথমে এনায়েতপুর কেজির মোড় এলাকা থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল এসে থানার মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এরপর আমরা তাদের অনুরোধ করে বলতে থাকি যে এটি জনগণের প্রতিষ্ঠান, আমরা আপনাদের শত্রু নই, কাজেই আপনারা এখানে এই ইটপাটকেল নিক্ষেপ বন্ধ করুন। অন্যথায় আমরা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো। আমাদের এমন অনুরোধে তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়।’
এর কিছুক্ষণ পরে আবারও একটি মিছিল এসে থানার মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে উল্লেখ করে শাহিনুর আলম বলেন, তাদের অনুরোধ করেও কোনো লাভ হয়নি। এরপর হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করা হয়। তখন তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে যায়। এর বেশ কিছুক্ষণ পর বেলা একটার দিকে একটি বড় মিছিল নিয়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে থানার ভেতরে ঢুকে হামলা চালায় বিক্ষোভকারীরা। এ সময় কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করলেও কোনো লাভ হয়নি।
শাহিনুর আলম বলেন, ‘একপর্যায় আমরা তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাইলেও তারা চার থেকে পাঁচ হাজার লোক থানার চারপাশের এলাকা ঘিরে ফেলে আক্রমণ চালায়। যে কারণে আমরা সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ জন পুলিশ সদস্য প্রাণ বাঁচাতে যে যার মতো করে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করি।’
পুলিশ পরিদর্শক শাহিনুর আলম বলেন, ‘বিক্ষোভকারীরা প্রথমে থানায় ঢুকে থানা কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়ে মুল ফটকে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় থানা কার্যালয়ে নিচ তলায় থাকা আমরা ৯ পুলিশ সদস্য কৌশলে ভবনের ছাদের ওপরে গিয়ে পানির ট্যাংকের নিচে লুকিয়ে যাই। হামলাকারীরা প্রথমে থানা কার্যালয়ের নিচতলায় মূল ফটকে অগ্নিসংযোগ করায় আর ওপর ওঠেনি। আমরা সেই পানির ট্যাংকের নিচে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় বেলা আড়াইটা থেকে ৯ পুলিশ সদস্য সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করতে থাকি।’
এরপর তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও দীর্ঘ সময়ে কোনো উদ্ধার তত্পরতা শুরু হয়নি বলে জানান শাহিনুর আলম। তিনি আরও বলেন, ‘সন্ধ্যায় সেনা সদস্যদের গাড়ির হুইসেল শুনে আমরা সেখান থেকে বের হই। তাদের কাছে সাহায্য চাইলে তারা আমাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমার সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্যদের সবাই শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন।’
শাহিনুর আলম বলেন, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অনেকেই থানার পেছন পাশে ভাঙা দেয়ালের ভেতর দিয়ে বের হয়ে উত্তর পাশের বাড়িগুলোয় ঢুকে পড়ে। হামলাকারীরা সেখান থেকে ধরে এনে এনে পিটিয়ে হত্যা করতে থাকে তাঁদের। হামলাকারীরা বেলা ১টা থেকে বিকেল প্রায় ৪টা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় থানা এবং এর আশপাশের এলাকায় অবস্থান করে এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাঁরা থানার মধ্যে থাকা প্রতিটি আবাসিক ভবন, গাড়ি, মোটরসাইকেলসহ আসবাবপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। আবাসিক ভবনে থাকা বেশকিছু পরিবারের শিশু ও নারী সদস্যরা থানার পেছনের কিছু বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে প্রাণে বেঁচে আছেন।
সিরাজগঞ্জে সংঘর্ষ, বর্তমান ও সাবেক দুই সংসদ সদস্যের বাড়িতে ভাঙচুর
হামলার সময় থানায় পুলিশ সদস্যের মধ্যে ছিলেন ট্রাফিক কনেস্টবল আবদুর রহমান। হাসপাতালে চিকিত্সারত আবদুর রহমান বলেন, ‘আমি হামলার শিকার হয়ে থানার পেছন দিয়ে দৌড়ে পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। হামলাকারীরা আমার পিছু নিলেও ওই বাড়ির মালিক আমাকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে। সে বাড়িতেও বেশ কয়েকবার হামলাকারীরা কোনো পুলিশ সদস্য পালিয়ে আছে কি না, সেটি তল্লাশি চালিয়ে দেখে চলে গেছে। এরপর সন্ধ্যায় আগে ওই বাড়ির মালিকের সহায়তায় থানা এলাকা পার হয়ে আবারও আমি থানার পাশের খোকশাবাড়ি গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেই। এরপর সন্ধ্যায় সেনা সদস্যরা এলে খবর পেয়ে তাদের কাছে চলে আসি।’
আবদুর রহমান বলেন, ‘আমি যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম ওই বাড়ির পাশের বাড়িতে আমাদের বেশ কয়েক জন পুলিশ সদস্য আশ্রয় নিয়েছিলেন। হামলাকারীরা বাড়িতে ঢুকে সেই পুলিশ সদস্যদের পিটিয়ে হত্যা করেছে। আমি পালিয়ে থেকে সেই পুলিশ সদস্যদের আহাজারি, তাদের বাঁচার আকুতি, আর্তচিতকার শুনতে পেয়ে অসুস্থ বোধ করতে থাকি।’
পুলিশ সদস্যদের হত্যার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এনায়েতপুর থানার আশপাশের বেশ কজন বাসিন্দা। এমনই একজন নুরজাহান বেগম (৬০)। তিনি বলেন, ‘হামলাকারীরা কাঠের লাঠি, লোহার রড দিয়ে কীভাবে যে পুলিশ সদস্যদের ধরে ধরে চোখের সামনে পিটিয়ে হত্যা করল! আমরা কিছুই করতে পারলাম না। সে কথা মনে হলে আমার বুক কেঁপে ওঠে। হামলাকারীরা আশপাশের বাড়িতে পালিয়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের টেনেহিচড়ে বের করে পিটিয়ে হত্যার পর লাশগুলো আমার বাড়ির পাশে এক জায়গায় জমা করে রাখে। সেখানে এখনো রক্তাক্ত অবস্থা রয়েছে। রয়েছে রক্তের গন্ধ।’
নুরজাহান বেগম বলেন, তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে তিনজন পুলিশ সদস্যের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করেছেন। হামলার তীব্রতা যখন চরম, ঠিক এমন সময় তাঁর বাড়ির ভেতরে ঢুকে তিন পুলিশ সদস্য সাহায্য চান। তখনই তিনি দ্রুত ঘরে থাকা সাধারণ পোশাক দিয়ে তাঁদের পুলিশের পোশাক পরিবর্তন করে নিরাপদ হেফাজতে রাখেন। দীর্ঘ সময় পর হামলাকারীরা চলে গেলে তাঁদের বাড়ি হতে বের করে দেন। হামলাকারীরা বেশ কয়েক বার এসে হুমকি দিয়ে বলতে থাকে বাড়িতে পুলিশ লুকিয়ে আছে, তাদের বের করে না দিলে এই বাড়িতেই হামলা করা হবে। একবার কয়েক জন এসে ঘরের দরজা খুলতে বলে। এরপর ঘরে ঢুকে তারা তন্য তন্য করে খুঁজে চলে যায়।
এনায়েতপুর গ্রামের বৃদ্ধ বাবু প্রামাণিকের (৭০) বাড়ির উঠানেই কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। সেই বর্ণনা দিয়ে বাবু প্রামাণিক বলেন, থানা এলাকায় হামলা, গুলির শব্দ চলে বেলা একটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত। এরই একপর্যায়ে পাঁচ থেকে ছয়জন পুলিশ সদস্য থানার পেছন দিয়ে দৌড়ে এসে তাঁদের বাড়ির ভেতরে ঢুকে আশ্রয় চান। সেই সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে বাড়ির পেছন দিকে থাকা পাকা বাথরুমের মধ্যে ঢুকে পরে। হামলাকারীরা পিছু পিছু বাড়ির ভেতরে ঢুকে পুলিশ সদস্যদের খোঁজ করতে থাকে।
বাবু প্রামাণিক বলেন, ‘আমারা ভয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে বসে থাকি। এরই একপর্যায়ে হামলাকারীরা বাথরুমে ঢুকে সেই পুলিশ সদস্যদের টেনেহিঁচড়ে বের করে। আমার বাড়ির উঠানের মধ্যেই পিটিয়ে হত্যা করে লাশ টেনে বাড়ির বাইরে নিয়ে জমা করে। চোখের সামনে সেই হত্যার যে কী দৃশ্য, সেটি আমি বর্ণনা করতে পারব না।’
থানার পেছনের এলাকার খোকসাবাড়ি গ্রামে বৃদ্ধ জহির উদ্দিনের (৭৫) বাড়ি। এমন হত্যাযজ্ঞ জীবনে দেখেননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বেলা তিনটা দিকে থানার পেছনের জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে থাকা বেশ কয়েক জন পুলিশ সদস্যকে হামলাকারীরা খুঁজে বের করে কাঠের লাঠি ও লোহার রড দিয়ে পেটাতে শুরু করে। সে সময় জীবন বাঁচাতে কোনো পথ না পেয়ে তাঁরা পাশের পুকুরের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। হামলাকারীরা সেই পানিতে নেমেই তাদের পিটিয়ে হত্যা করে লাশগুলো টেনে তুলে পাড়ে জমা করে। একটি লাশ পরে সেনা সদস্যরা পুকুরের পানি থেকে উদ্ধার করেছেন।’
জহির উদ্দিন বলেন, হামলাকারীদের বেশির ভাগের বয়স ১৭ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে দু–একজনের বয়স ৪০-৪৫ হবে। তবে তারা কেউই স্থানীয় নয়। সবাই তাঁদের অপরিচিত। তাদের কাউকেই এলাকার মানুষ আগে কখনো দেখেননি।
হামলার পর গত রোববার ১৩ পুলিশ সদস্যের লাশ উদ্ধার করা হয়। গতকাল সোমবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজনের মৃত্যু হয়।