পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান পুলিশ কর্মকর্তার ছেলে

‘পুলিশের ছেলে পুলিশেরই গুলিতে মরল, আমার স্বামী এই প্রতিদান পাইল? আমার ছেলেরে কতগুলা গুলি দিছে, ছেলে তো চোর-সন্ত্রাসী ছিল না। যে মারল, তার একটুও মায়া লাগে নাই? মারতে কয়টা গুলি লাগে? …আমি সঠিক বিচারটা চাই।’ ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বললেন ইমাম হাসান ভূঁইয়া তাইমের (১৯) মা পারভীন আক্তার।

রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের জ্যেষ্ঠ উপপরিদর্শক মো. ময়নাল হোসেন ভূঁইয়ার ছেলে ইমাম হাসান। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশের গুলিতে গত ২০ জুলাই যাত্রাবাড়ীর কাজলা পদচারী–সেতুর কাছে মারা যান ইমাম হাসান।

২৭ বছর ধরে পুলিশে কর্মরত ময়নাল হোসেন ছেলের মৃত্যুর পর থেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে রাজি হলেন না। ইমাম হাসান নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজী নগর এমডব্লিউ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন।

ইমাম হাসানকে পুলিশ গুলি করে। সে সময় এক বন্ধু তাঁকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ ঘটনাই ছবিতে তুলে ধরেছেন কেউ
ইমাম হাসানকে পুলিশ গুলি করে। সে সময় এক বন্ধু তাঁকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ ঘটনাই ছবিতে তুলে ধরেছেন কেউছবি: সংগৃহীত

কাজলা পদচারী–সেতুর বিপরীত পাশে পূর্ব রসুলপুরে তাঁদের ভাড়া বাসা ছিল। সে বাসায় ছেলের স্মৃতি তাড়া করছিল। তাই সবুজবাগ থানার মাদারটেকে নতুন ভাড়া বাসায় এসে ওঠে পরিবারটি। গত শুক্রবার সকালে সে বাসায় বসে কথা হয় ইমাম হাসানের মা, বড় ভাই সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া রবিউল আউয়াল এবং খালা শাহিদা আক্তারের সঙ্গে। আরেক ভাই জাহিদ হাসান মস্কো সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজও দেখেছেন পারভীন আক্তার। সে ফুটেজে ছেলেকে একদম কাছ থেকে পুলিশ গুলি করছে, এক বন্ধু ছেলেকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। একপর্যায়ে ওই বন্ধুও উপায় নেই দেখে ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়াচ্ছে, আর পুলিশ তখনো গুলি করছে। সে সময়ও জীবিত ছিল ছেলেটা।

ছেলের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান মা
ছেলের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান মাছবি: সংগৃহীত

গত ১৯ জুলাই থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার। ২০ জুলাই দুপুর ১২টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল ছিল। টানা আন্দোলনে যখন উত্তাল যাত্রাবাড়ী, তখন ইমাম হাসান সে আন্দোলনে অংশ নেন। যদি কিছু হয়, সেই ভয় থেকে তিন–চার দিন এমন পরিস্থিতির মধ্যেও ছেলের ব্যাগ কোলে নিয়ে মা ফুটপাতে বা একটু নিরাপদ জায়গায় বসে থেকেছেন। ঘটনার দিন দুপুর ১২টার পর ইমাম হাসান বন্ধুদের সঙ্গে পদচারী–সেতুর পাশে লিটন স্টোরে গিয়েছিলেন চা খেতে। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মায়ের কাছে রুটি খেতে চেয়েছিলেন। দুটো রুটি আর ভাজি ছিল তাঁর শেষ খাওয়া।

পারভীন আক্তার বললেন, ছেলে বের হওয়ার আধঘণ্টার মধ্যেই গুলি লাগার খবর আসে। বাসা থেকে ঘটনাস্থল খুব কাছে হলেও ঘুরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে শুধু রক্ত দেখেছেন, ছেলের লাশ পাননি।

আরও পড়ুন

ঝুলে থাকা অবস্থায় পুলিশের ছয় গুলি, সেই তরুণ বেঁচে আছেন

ঝুলে থাকা অবস্থায় পুলিশের ছয় গুলি, সেই তরুণ বেঁচে আছেন

পারভীন আক্তারকে ছেলে মারা যাওয়ার খবর জানানো হয় রাতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজও দেখেছেন পারভীন আক্তার। সে ফুটেজে ছেলেকে একদম কাছ থেকে পুলিশ গুলি করছে, এক বন্ধু ছেলেকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে। একপর্যায়ে ওই বন্ধুও উপায় নেই দেখে ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়াচ্ছে, আর পুলিশ তখনো গুলি করছে। সে সময়ও জীবিত ছিল ছেলেটা।

ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার–এর এক প্রতিবেদন বলছে, গত ২০ জুলাই মর্গে গিয়ে লাশ খুঁজে পাওয়ার পর ময়নাল হোসেন তাঁর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোনে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘একজনকে মারতে কতগুলো গুলি লাগে, স্যার?’

ইমাম হাসান
ইমাম হাসানছবি: সংগৃহীত

‘গুলি লেখা যাবে না’

ইমাম হাসানের সুরতহাল প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘ডান হাতের কনুইয়ের নিচে কবজি পর্যন্ত চারটি ছিদ্র…মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত প্রায় ১০০টি কালো ছিদ্র ও জখম…।’

সুরতহাল প্রতিবেদনে মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে সুরতহাল প্রস্তুতকারী কর্মকর্তা মন্তব্যের ঘরে মৃতের বাবা ময়নাল হোসেনের ভাষ্য হিসেবে লিখেছেন, ভিকটিমকে কোটা আন্দোলনকারীরা মারপিট ও গুলি করে জখম করে।

তবে এ বিষয়ে ময়নাল হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সেখানে দায়িত্বরতরাই নিজেদের ‘মনমতো’ এ কথা লিখেছেন। সরাসরি গুলি লেখা যাবে না, ছিদ্র লিখতে হবে—ওপর থেকে এমন নির্দেশ আছে বলে তাঁকে জানানো হয়েছিল।

ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার–এর এক প্রতিবেদন বলছে, গত ২০ জুলাই মর্গে গিয়ে লাশ খুঁজে পাওয়ার পর ময়নাল হোসেন তাঁর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ফোনে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘একজনকে মারতে কতগুলো গুলি লাগে, স্যার?’

আরও পড়ুন

ছোট্ট জাবিরের গুলি লাগে, কয়েক হাসপাতাল ঘুরেও বাঁচাতে পারেননি মা–বাবা

ছোট্ট জাবিরের গুলি লাগে, কয়েক হাসপাতাল ঘুরেও বাঁচাতে পারেননি মা–বাবা

চলছে মামলার প্রস্তুতি

ইমাম হাসানের বড় ভাই রবিউল আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিডিও ফুটেজ হাতে পাওয়ার পর বুঝতে পারছি, যে পুলিশ গুলি করেছেন, তিনিই বারবার বাবাকে ফোন করে নানা তথ্য জানতে চেয়েছেন। বাবার সঙ্গে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে গিয়েছি। তাঁরা সমবেদনা জানালেও আইনি ব্যবস্থা নিতে কোনো পরামর্শ দেননি। বরং বাবার কোনো কিছু করার দরকার নেই, পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে এমন কথাও বলেছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।’

ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার পেতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানালেন রবিউল আউয়াল। বললেন, ‘আমার দাদা আবদুল কাদের ভূঁইয়া পুলিশে চাকরি করেছেন। চাচা জয়নাল আবেদীন সেনাবাহিনীতে ছিলেন। বাবা পুলিশে কর্মরত। আমার ভাই ইমাম হাসানও পুলিশ হতে চায় বলে মাঝে মাঝে বলত। ভাইকে গুলি করে যারা হত্যা করল, তাদের বিচার চাই।’

গুলি লাগলেও ওকে ছেড়ে দিইনি। পেছন দিকে টানতে থাকি। আমার পায়ে যন্ত্রণা শুরু হয়। তখন ও (ইমাম হাসান) বলছিল, “ভাই আমার শরীরে শক্তি নাই, তুমি ছেড়ে দাও।

রাহাত

বন্ধুকে বাঁচাতে পারলেন না

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে নীল রঙের টি–শার্ট গায়ে যে তরুণ গুলি লাগা ইমাম হাসানকে পেছন থেকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তিনি মো. রাহাত হোসাইন। শুক্রবার তাঁর সঙ্গে কথা হয় কাজলা এলাকায় লিটন স্টোরের সামনে। রাহাত জানালেন, তিনি, ইমাম হাসান, শাহরিয়ার আজাদ এখানে বসে চা খাচ্ছিলেন। কয়েকজন পুলিশ এসে চায়ের দোকান থেকে তাঁদের তিনজনকে বের করে প্রথমে মারধর করেন। পরে ইমাম হাসানকে লক্ষ্য করে গুলি চালান এক পুলিশ। পেছন থেকে তিনি (রাহাত) যখন ইমাম হাসান টেনে নিচ্ছিলেন, তখনো পুলিশ গুলি করছিল। তাঁর পায়েও গুলি লাগে।

রাহাত বলেন, ‘গুলি লাগলেও ওকে ছেড়ে দিইনি। পেছন দিকে টানতে থাকি। আমার পায়ে যন্ত্রণা শুরু হয়। তখন ও (ইমাম হাসান) বলছিল, “ভাই আমার শরীরে শক্তি নাই, তুমি ছেড়ে দাও।” তখনো সে জীবিত ছিল। দুদিন পর জানতে পারি ও মারা গেছে।’

রাহাত এখনো সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না। বললেন, বন্ধুকে বাঁচাতে না পারার আক্ষেপ থাকবে সারা জীবন। তাঁকেও পুলিশ ধরতে এসেছিল। বাড়িওয়ালার সহায়তায় সে যাত্রায় বেঁচে যান। পালিয়ে থাকেন কয়েক দিন।

‘পুলিশদের কাছে বলি, ও (ইমাম হাসান) পুলিশের ছেলে, ওকে বাঁচান। তখন একজন বলেন, বাঁচাইতাছি, তুমি আগে এইখান থেকে যাও, না হলে তুমিও গুলি খাবা।

শাহরিয়ার আজাদ

অপর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, খালি গায়ে শাহরিয়ার আজাদ এবং লিটন স্টোরের লিটন মিলে ইমাম হাসানকে তোলার চেষ্টা করেও তুলতে পারেননি। ইমাম হাসানের বন্ধু শাহরিয়ার আজাদের বাবাও (বাবার নাম প্রকাশ করতে চাননি) পুলিশে কর্মরত। সেদিন শাহরিয়ারের গায়ে ছিল পুলিশের লোগোসহ তাঁর বাবার একটি টি–শার্ট। পুলিশ প্রথমে শাহরিয়ারকেও মারধর করে।

শাহরিয়ার আজাদ বলেন, ‘পুলিশদের কাছে বলি, ও (ইমাম হাসান) পুলিশের ছেলে, ওকে বাঁচান। তখন একজন বলেন, বাঁচাইতাছি, তুমি আগে এইখান থেকে যাও, না হলে তুমিও গুলি খাবা।’ এরপর শাহরিয়ার ঘটনাস্থল থেকে দৌড়ে ইমাম হাসানের বাসা পর্যন্ত খবরটা পৌঁছাতে দিতে পেরেছিলেন।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।