আবু তালেব
সাতক্ষীরার বেশির ভাগ মানুষ জন্মগতভাবেই ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে। এই জমিনকে আরো বেশি উর্বর করেছে সাতক্ষীরার ৩৭টি প্রিয় তাজা গোলাপ। যে গোলাপের পাপড়িগুলো ঝরে পড়ার পর আরো বেশি সুগন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে। শহীদ আলী মোস্তফা, আমানউল্লাহ, শামসুজ্জামান খান রেজা, রফিকুল ইসলাম, মোস্তফা আরিফুজ্জামান, আরিজুল ইসলাম, হোসেন আলী, ইকবাল হাসান তুহিন, আলী মোস্তফা (২), আবু হানিফ ছোটন, আবুল কালাম ও শহীদ আমিনুর রহমানসহ অনেক ভাই শাহাদাত বরণ করেছেন বাতিল শক্তির হাতে। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে সাতক্ষীরা শহরের কদমতলায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের আয়োজন করে জামায়াতে ইসলামী সাতক্ষীরা জেলা শাখা। নিজেদের আবেগ অনুভূতি নিয়ে এই রায়ের প্রতিবাদ জানাতে উপস্থিত হয় সাঈদীভক্ত হাজার হাজার তৌহিদী জনতা। বিক্ষুব্ধ মানুষের ঢল নামে। হাজার হাজার মানুষ সমাবেশ শেষে মিছিলসহকারে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মিছিলটি শহর অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। অন্য দিকে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সকল সন্ত্রাসীকে একত্র করে ইসলামী আন্দোলনের সূর্যকে চিরতরে নিভিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশের ছত্রছায়ায় ওঁৎ পেতে থাকে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। মিছিলটি সার্কিট হাউজ মোড়ে পৌঁছানো মাত্র শুরু হয় অবিরাম গুলিবর্ষণ। যে বিজিবি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে সীমান্ত রক্ষায় দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে, অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে যে পুলিশ বাহিনী দিন-রাত পরিশ্রম করে, সন্ত্রাস দমনের জন্য যে র্যাবের প্রতিষ্ঠা- সেই আইন রক্ষার বাহিনীই ঝাঁপিয়ে পড়ে কিছু রাসূলপ্রেমিক মুসলমানের ওপর। একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তৌহিদী জনতা। পিচঢালা রাজপথ রক্তের ফোঁটায় ফোঁটায় লালবর্ণ ধারণ করে। শহীদের মিছিল দীর্ঘ থেকে হয় দীর্ঘতর। আহতদের তালিকা বাড়তে থাকে। কাকে রেখে কাকে হাসপাতালে নেবে এ চিন্তায় অনেকে বেসামাল হয়ে পড়ছিল। একজনের পাশে গেলে বলে, আমার থেকে ঐ সামনের ভাইটি বেশি আহত, উনাকে হাসপাতালে নেন। স্মরণ করিয়ে দেয় ওহুদ যুদ্ধে আহত সাহাবীদের পানি পান করানোর সেই ঘটনা। পুলিশের এই নির্মমতায় একে এক ঝরে পড়ে ১০টি তাজা প্রাণ। গুলিবিদ্ধ হয় প্রায় অর্ধশতাধিক। গুলিবিদ্ধদের টেনেহিঁচড়ে গ্রেফতার করে ফেলে রাখা হয় রাস্তার ওপরে। এই ঘটনায় নিহতরা হলেন- শশাডাঙ্গার শিবিরের সাথীপ্রার্থী আলি মোস্তফা (২০), হরিশপুরের শিবিরকর্মী ইকবাল হাসান তুহিন (২০), খানপুরের জামায়াতকর্মী সাইফুল্লাহ (২০), সদরের ঘোনার জামায়াতকর্মী রবিউল ইসলাম (৩০), বকেরডাঙ্গার জামায়াতকর্মী শাহিন (২০), মোশরাফ হোসেন (৩০), ইমদাদ হোসেন (৩০), ঘোনার জামায়াতকর্মী আনারুল ইসলাম (৩০) ও ইকবাল। গুলিবিদ্ধ হয়ে চিরতরে পঙ্গু হন সাবেক সিটি কলেজ সভাপতি ও সাংবাদিক আব্দুল আহাদ, শিবিরের সাথী মুস্তাকিম বিল্লাহ, চোখ হারান শিবিরকর্মী আরিফুল ইসলাম এবং গুলিবিদ্ধ হন অর্ধশতাধিক জামায়াত-শিবির কর্মী। ইসলামবিদ্বেষী শক্তি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার যেন সেদিন কিছুটা পূরণ হয়। সাতক্ষীরায় ইসলামবিদ্বেষীরা প্রথম আঘাত হানে ১৯৮৭ সালে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ ও বাসদসহ সকলে মিলে ছাত্রশিবির ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। অতর্কিত হামলা চালিয়ে আহত করে অনেক ভাইকে। এখানেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। খুনের নেশায় মত্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে যাওয়া ভাইদের হাসপাতালের গেটে পুনরায় হামলা করে সকল পৈশাচিকতাকে হার মানায় সেদিন। এরপর ১৯৯৪ সালের ৩০ মার্চ অধ্যাপক গোলাম আযমের সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের সহযোগিতায় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা সমস্ত শহরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। রাস্তা-ঘাট, শহর-বন্দর সকল জায়গায় দাড়ি-টুপিওয়ালা দেখলেই অতর্কিত হামলা শুরু। সেদিন গণগ্রেফতার ও মামলা করা হয় অসংখ্য নেতাকর্মীর নামে। ২০০৯ সালে সেনাশাসিত নির্বাচনে জয়লাভ করে মহাজোট সরকার। ’৭১ সালের পর এই প্রথম সাতক্ষীরা সদর আসনে জামায়াতে ইসলামীকে কারচুপির মাধ্যমে পরাজিত করে মহাজোট। ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারুক হত্যার পর সরকারের পক্ষ থেকে চিরুনি অভিযানের ঘোষণা দেয়া হয়। সাতক্ষীরা জেলায় সাম্রারাজ্যবাদী, অপশক্তির নির্মমতায় এ পর্যন্ত প্রাণ দিয়েছেন ১৯৯৩ সালে ৩ জন, ১৯৯৯ সালে ১ জন, ২০০০ সালে ১ জন, ২০১৩ সালে ১২ জন এবং ২০১৪ সালে ২০ জন। শাহাদাতের সিদ্ধান্ত মহান আল্লাহর নিজস্ব এখতিয়ার। শহীদ ভাইদের মায়েদের চোখের পানি, দীর্ঘদিন নফল রোজা রাখা ও রাত জেগে আল্লাহর কাছে প্রিয় সন্তান ও এই কাফেলার সাফল্য কামনা নিশ্চয়ই বৃথা যাবে না। হাদিসে বর্ণিত : কোন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করার পর পৃথিবীতে ফিরে আসার প্রত্যাশা করবে না, কিন্তু একজন শহীদ পৃথিবীতে এসে দশবার শহীদ হওয়ার কামনা করবেন। (সহীহ আল বুখারী ও মুসলিম) আজ সেসকল শহীদের পবিত্র আত্মার উদ্দেশে বলতে চাই, প্রতিটি গোলাপের মাঝে আমরা আপনাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাই। আমরা আপনাদেরকে ভুলিনি। যে পৃথিবীর নষ্ট মানুষেরা আপনাদেরকে আমাদের থেকে অন্য এক ভুবনে চলে যেতে বাধ্য করেছে, সে নষ্ট পৃথিবীর ধ্বংসস্তূপে একটি নতুন পৃথিবী গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে আপনারা ছুটে বেড়াতেন দিন-রাত। একই স্বপ্ন বুকে নিয়ে আজও লাখো তরুণ এগিয়ে চলেছে দৃপ্ত পদক্ষেপে। সাতক্ষীরার মাটি আপনাদের আত্মত্যাগ ভুলে যাবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সকল শহীদকে কবুল করুন। জান্নাতের মেহমান হিসেবে মর্যাদা দান করুন। আমিন।