টানা বৃষ্টিপাতে তলিয়ে গেছে সাতক্ষীরাঃ ১০ লক্ষ মানুষ পানি বন্ধি

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ভ্রান্তনীতি, দুর্নীতি, লুটপাট ও ভারতের একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণের কারণে জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৫০ লাখ মানুষ। টানা তিন দিনের আকাশ পানিতে তলিয়ে গেছে জেলার নি¤œ অঞ্চল। পানিতে ভেসে গেছে শত শত মাছে ঘের ও পুকুর। প্রতিদিন ডুবছে নতুন নতুন এলাকা। ঘর বাড়ি ছাড়তে শুরু করেছে ভুক্তভোগীরা। সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার সকাল থেকে রোববার দূপুর পর্যন্ত সাতক্ষীরায় ১৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সাতক্ষীরা শহর ও তার আশেপাশের প্রায় অর্ধেক এলাকা পানিতে নিমজ্জিত। বিশেষ করে কামালনগর, পুরাতন সাতক্ষীরা, বদ্দিপুর কলোনি, ঘুড্ডিরডাঙি, রসুলপুর, পলাশপোল, ইটাগাছা,কুখরালিসহ শহরের অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এমনিতেই মাসের পর মাস এসব এলাকা পানিতে ডুবে ছিল। তারপর ভাদ্র মাসের বৃষ্টি এসব এলাকার মানুষকে চরম দুর্ভোগে ফেলেছে। নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ পড়েছে চরম বিপাকে। রোজগার করতে না পারায় অনেকের চুলো পরযন্ত জ্বলছে না। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, টানা বৃষ্টিপাতের কারণে যেসব এলাকায়জোয়ার-ভাটার ব্যবস্থা নেই, সেসব এলাকায় দুই থেকে তিন ফুট পরযন্ত পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, এই জনপদকে কেন্দ্র করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড, টেকসই বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। ঠিকাদারসহ একটি স্বার্থবাদী চক্রের অবৈধ অর্থ উপার্জনের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। ক্রুগ মিশনের পরামর্শে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পাকিস্থান আমলের পানিনীতি বাংলাদেশ আমলেও অব্যাহত রাখা হয়েছে, যে নীতি এ অঞ্চলের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, নদী পানি ব্যবস্থাপনা, জীববৈচিত্র্য ও জীবনযাত্রার প্রণালী বিপর্যস্থ করে স্থায়ী সংকট সৃষ্টি করে।

সাতক্ষীরার বেতনা ও মরিচ্চাপ নদী এবং যশোরের ভবদহ অঞ্চলে জলাবদ্ধতা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। বছরের ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে সাতক্ষীরা জেলার বেশিরভাগ এলাকা পানি নিচে থাকে। বেতনা নদী কোনোরকমে টিকে রয়েছে। অপরদিকে মরিচ্চাপ নদী মৃত্যুর প্রহর গুনছে। এছাড়া গোয়ালঘেশিয়া নদীর অকাল মৃত্যু ঘটেছে এবং খোলপেটুয়া নদীও পড়েছে মৃত্যুর মুখে। এরই মধ্যে বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর মৃত্যু এবং জনদুর্ভোগ কমাতে সরকার চার বছর মেয়াদি ৪৭৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা ও যশোরের ভবদহ নদী খননে ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এ প্রকল্প বাস্থবায়ন হলে সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া, দেবহাটা, আশাশুনি ও তালা উপজেলার ১৫ লাখ মানুষ জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে বলে প্রত্যাশা করা হলেও প্রকল্প গ্রহণে আইডব্লিউএমের সুপারিশ উপেক্ষা করে টিআরএম বাদ দেয়া হয়েছে। এতে প্রকল্প বাস্থবায়ন হলেও জলাবদ্ধতা তেমন হ্রাস পাবে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে যশোরের ভবদহ অঞ্চলের স্থায়ী জলাবদ্ধতা নিরসনে টিআরএম পদ্ধতি বাস্থবায়ন না করে লাখ লাখ মানুষকে জিম্মি করে এবং তাদের দুর্দশাকে পুঁজি করে লুটপাট চালাতে ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে, যে প্রকল্পে বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় জনমতকে উপেক্ষা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড লুটেরাদের দুর্গে পরিণত হয়েছে। তারা নদী কেটে খাল বানায়, খাল কেটে নালা বানায়। ইতিপূর্বে তারা সাতক্ষীরার বেতনা ও মরিচ্চাপ নদী খনন করে খাল তৈরি করেছে। একই ভাবে নতুন করে গৃহীত প্রকল্পে আইডব্লিউএম টিআরএম অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করলেও তা বাদ দেয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অপরিণামদর্শিতায় এই প্রকল্প বাস্থবায়ন না হলে জলাবদ্ধতা নিরাসন ও টেকসই ভেঁড়িবাধ সম্ভব নয়বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ এলাকার রিপন বিশ্বাস বলেন, বৃষ্টিতে কলেজ মাঠসহ অনেক সড়ক তলিয়ে গেছে। বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চলাচলে মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন মানুষ। এমন অবস্থা যে, চলাচল করতে গিয়ে মানুষ দুর্ঘটনায় পড়ছেন। নর্দমার পানি এত নোংরা যে, পানি মাড়িয়ে রাস্থা পার হলে সঙ্গে সঙ্গে পায়ে চুলকানি শুরু হয়।

বিনেরপোতা এলাকার মামুন হোসেন বলেন, বিনেরপোতা, গোপীনাথপুর, মাগুরা, খেজুরডাঙ্গা ও তালতলা এলাকার নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। অনেকের বাড়িঘরে পানি উঠে গেছে। অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। এলাকার কবরস্থান পর্যন্ত
পানির নিচে ডুবে রয়েছে। রাস্থাও পানির নিচে ডুবে রয়েছে। যাতায়াতে ব্যাপক দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন মানুষ। ফসলের মাঠ ও পুকুর পানিতে একাকার হয়ে গেছে। রসুলপুর এলাকার বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম ইমরান বলেন, এলাকায় পানি নিষ্কাশনের কোনো পথ নেই। রাস্থার ওপর পানি জমেছে। প্রতিবছরই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। অথছ দেখার কেউ নেই।

সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। শুক্রবার সকাল থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত সাতক্ষীরায় ১৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা চলতি বছরে এ জেলায় সব থেকে বেশি বৃষ্টিপাত। মঙ্গলবার বিকেল থেকে বৃষ্টিপাত কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বিকেল থেকে স্বাভাবিক হতে পারে আবহাওয়া, এমনটি জানিয়েছেন আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা।

 

Check Also

আশাশুনি উপজেলা শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

সভাপতি-অধ্যাপক শাহজাহান,সেক্রেটারী বোরহান উদ্দীন মনোনীত এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি প্রতিনিধি।।বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন আশাশুনি উপজেলার দ্বি-বার্ষিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।