সাতক্ষীরায় ২৭টি নদীর ১৩ টি পলিপড়ে ভরাট
#অস্তিত্ব সংকটে সাতক্ষীরার ৪২৯টি খাল
আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা থেকে: পানিবদ্ধতার কবলে পড়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে জেলার প্রায় ১০ লাখ মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তন, নদীর নাব্যতা হ্রাস, পলিপড়ে নদীর তলদেশ ভরাট, অকেজো স্লুইস গেট, খননের নামে চরম দুর্নীর্তি ও ভারতীয় নদী আগ্রাশানকে এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে। ফলে ফসলের মাঠ, মৎস্য ঘেরসহ গোটা জেলার নিন্ম অঞ্চল যেন পানিতে ভাসছে। পানির প্রবাহ হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে জেলার ৪২৯টি খাল। এসব খালের উপর নির্মিত ২১৬টি স্লুুইস গেটের বেশির ভাগ অকেজো। ২৭টি নদীর ১৩ টি পলিপড়ে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে এসব নদী থেকে প্রবাহিত চার শতাধিক খাল তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। বেশিরভাগ খাল প্রভাবশালীদের দখলে। এসব খালে বাধ দিয়ে লোনা পানি তুলে মাছ চাষ করা হচ্ছে। মাত্র কয়েকটি খাল পানিউন্নয়ন বোর্ড ও জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দর্শকে এসব খালের উপর নির্মিত ২১৬টিস্লুইস গেটের মেয়াদ প্রায় শেষ।
পানিউন্নয়ন বোর্ড বলছে জেলার ১৪টি নদী কোন রকমে টিকে আছে। এসব নদীর শাখা প্রশাখায় প্রবাহিত রয়েছে ৪২৯ টি খাল। পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রভাবে যার বেশির খাল এখন অস্তিত্ব হারিয়েছে। অনেক জায়গায় নদী ও খালের বুকে জেগে উঠা চরে মানুষ বসতি শুরু করেছে। সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগে ২১৬টি স্লুইস গেট রয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর অধীনে ১২৩টি স্লুইস গেট রয়েছে। যার ৮০টি কার্যক্ষম আছে বাকি ৩৪ টি সম্পূর্ণ অকেজো। এছাড়া সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর অধীনে ৯৩ টি স্লুইস গেটের মধ্যে ২৮টি সম্পূর্ণ অকেজো। ৫০টির তলদেশ পলি জমে উঁচু হয়ে যাওয়ায় এগুলো পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। পাউবো-১ এর একটি তথ্যে দেখা যায় ১২৩টি স্লুুইস গেটেরে মধ্যে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সালে নির্মিত ৩৫টি,১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সালে নির্মিত ৫টি,১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সালে নির্মিত ৩০টি, ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৬ সালে নির্মিত ৪৮টি এবং ১৯৮৯ থেকে ৯৩ সালে নির্মিত ৫টি। যার বেশির ভাগ স্লুুইস গেটের মেয়াদই শেষ।
জলবায়ু প্রকল্পের আওতায় ২০১৩ সালের ২৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সাতটি প্যাকেজে নদী খননের কাজ করা হয়। ২০১১ সালে কপোতাক্ষ নদ খননের জন্য ৪ বছর মেয়াদী প্রায় ২৬২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সেই প্রকল্পের বেশির ভাগ টাকায় লুটপাট হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। স্কেবেটর মেশিন দিয়ে দিয়ে চেঁচে-ছিলে দায়সারা গোচের খনন করা হয়েছে। ২৫ কোটি টাকার খনন করা হয়েছে সাতক্ষীরার এক সময়ের প্রমত্তা বেতনা নদী । কিন্তু খননের পূর্বের অবস্থার চেয়ে বর্তমান অবস্থা আরো খারাপ। খনন কাজের পূর্বে নদীটি কমপক্ষে ১৫০ থেকে ২০০ মিটার চওড়া ছিল। কিন্তু খননের পর নদীটি পরিণত হয়েছে নালায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, যাচ্ছে তাই ভাবে নদীটি খনন করায় দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। বেতনা নদীর মাঝ বরাবর খনন করার কথা ছিল ১০ থেকে ১৮ ফুট। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়নে সাতক্ষীরার বেতনা নদী খনন ও পাড় বাঁধাই করার জন্য ২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ২৫ কোটি টাকার ওই প্রকল্পে নামমাত্র কাজ করে টাকা তোলার অভিযোগ আছে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে। স্থানীয়রা জানান, সাতক্ষীরায় বেতনা ছাড়াও মরিচ্চাপ নদী অদক্ষ পরিকল্পনার বলি হয়েছে। এছাড়া যমুনা, শালতা, শালিখা, সাপমারাসহ বিভিন্ন নদী-খালের অবস্থাও একই।
পানিউন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ ৫৩১ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পে কাজ চলছে। প্রকল্পটির কাজ ২০২০ সালে শুরু হয়ে শেষ হবে ২০২৪ সালে। জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পটি যশোর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলার মোট ১১টি উপজেলায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। দুই প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৮১৭ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জুন মাসে শেষ হওয়া প্রকল্পটি এক বছর বাড়ানো হয়েছে ও বর্তমান পানি উন্নয়ন বোর্র্ডের ওয়েবসাইটে চলমান প্রকল্প হিসেবে দেখা যায়। এখন পর্যন্ত ৬৫ শতাংশ শেষ হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
জলাবদ্ধতা নিরসনে গতকাল সাতক্ষীরা পাবলিক লাইব্রেরী মিলনায়তনে এক নাগরিক সংলাপে বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীতে জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিকপ্রবাহ ফেরানো, সাতক্ষীরা পৌরসভাকে পুরোপুরি ড্রেনেজ নেটওয়ার্কের আওতায় আনা, পানি নিষ্কাশনের জন্যপ্রাণসায়ের খালের দুই মুখ উন্মুক্ত করে স্বাভাবিক প্রবাহ ফেরানো, আন্তঃনদী সংযোগ বিশেষ করে ইছামতি, মরিচ্চাপ, খোলপেটুয়া, বেতনা, শালিখা ও কপোতাক্ষকে খননের আওতায় এনে চিরায়ত নিয়মে পানি প্রবাহ সচলকরণ, নদীগুলোর সাথে সংযুক্ত খালগুলো পুনঃখনন করে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি, অকেজো হয়ে পড়ে থাকা স্লুইসগেটগুলো সংস্কারকরণ, পৌর এলাকার মধ্যে মৎস্য ঘের নিষিদ্ধকরণ, নদীগুলো খননের সঙ্গে সঙ্গে সংলগ্ন বেড়িবাঁধগুলোও টেকসই করে বেড়িবাঁধ ভাঙন রোধ, বেড়িবাঁধে বনায়নের উদ্যোগ গ্রহণ, নদী ও খালেরপ্রবাহ বিঘ্নিত হয় এমন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ না করা, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের আগেই পানি নিষ্কাশনের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজ নিরুপণের মাধ্যমে জলবায়ু ফান্ডের অর্থ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে পুনর্বাসনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করারপ্রস্তাব রাখা হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, নদীতে জোয়ার সৃষ্টি ও খালে প্রবাহ বৃদ্ধি, অকেজো স্লুইস গেট গুলো কার্যকর করাসহ পানিবদ্ধতা নিরাশানে আমরা কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। এছাড়া প্রয়োজনীয় বরাদ্ধের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছি।