আবু সাইদ বিশ^াস, সাতক্ষীরাঃ প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের ১৭ বছর পরও অরক্ষিত রয়েছে দেশের দক্ষিণের গোটা উপকূলীয় এলাকা। প্রতিবছর জোড়াতালি দিয়ে ষাটের দশকে তৈরি মাটির বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হলেও তা প্রতিটি দুর্যোগে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। প্রতিবার ঘূর্ণিঝড়—জলোচ্ছ্বাস ও বেড়িবাঁধ ভেঙে ঘটে প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। উপকূলীয় জেলাগুলোতে নেই পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টারও। অরক্ষিত উপকূলীয় এলাকার মানুষের জন্য দীর্ঘদিনেও নেওয়া হয়নি কোনো মহাপরিকল্পনা। সূত্রমতে পৃথিবীর বৃহৎ বদ্বীপ বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত বাংলাদেশর উপকূলীয় অঞ্চলের অস্থিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। উপর্যুপরি দুর্যোগ, জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, চিংড়ি চাষ, নদীর ভাঙন,ভারতীয় ফারাক্কা বাঁধসহ নানা কারণে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলী জেলা সমূহে জনসংখ্যা কমে অন্যত্র অভিগমন করছে। গবেষণায় দেখা গেছে,এ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে উপকূলীয় এলাকায় ২০৫০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা আরও ১৩ লাখ কমে যেতে পারে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে জনসংখ্যা কমে যাওয়ার প্রতিটি কারণই ভবিষ্যতে তীব্রতর হবে। দেশের সাগর তীরবর্তী অর্থাৎ উপকূলীয় ২১টি জেলায় লাখ লাখ মানুষের বসবাস। কিন্তু এই বিস্তীর্ণ উপকূলের যথাযথ সুরক্ষা না থাকায় উপকূলের রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধ ক্ষতবিক্ষত হয়ে আজ উপকূল বাসির জন্য অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দেশের উপকূল সুরক্ষায় ১২৩টি পোল্ডারের অধীনে পাউবোর পাঁচ হাজার ১০৭ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ৯৫৭ কিলোমিটার হচ্ছে সমুদ্র—তীরবর্তী বাঁধ। সমুদ্রের তীরবর্তী এ বাঁধের সিংহভাগই সাতক্ষীরা,খুলনা, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলার আওতায়। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের সিডরে উপকূলীয় অঞ্চলের দুই হাজার ৩৪১ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ও সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ছয় জেলার প্রায় ১৮০ কিলোমিটার সম্পূর্ণ এবং এক হাজার ৪০০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল শতাব্দীর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৩ মে ফণি, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান উপকূলীয় বেড়িবাঁধে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। যা এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারিনি । এতে করে উপকূলবাসী জীবন—জীবিকা এবং মূল্যবান অবকাঠামো হুমকির মুখে রয়েছে।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার বেগে বাতাসের সঙ্গে ১০—১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস নিয়ে আঘাত করেছিল ঘূর্ণিঝড় সিডর। এতে বাগেরহাটে ৯০৮ জন, খুলনায় ৪৫ জন, বরগুনায় ১ হাজার ৩৪৫ জন ও পটুয়াখালীতে ৪৬৬ জন নিহত হন। এ ছাড়া আহত হন অসংখ্য মানুষ। ভেঙে যায় ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গাছপালা। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সড়ক, বেড়িবাঁধ। বিনষ্ট হয় ফসলের ক্ষেত, ভেসে যায় চিংড়ি ঘের ও পুকুর। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ১ হাজার ৯৮৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ৬০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এখনো ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশের উপকূলীয় পোল্ডারগুলো অনেক পুরোনো। বেশির ভাগেরই বয়স ৫০—৬০ বছরের বেশি। এগুলো মাটির তৈরি হওয়ায় এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। উপরন্তু চিংড়ি চাষের সুবিধার্থে লবণপানি ঢোকানোর জন্য যত্রতত্র বাঁধের ভেতরে ছিদ্র করায় বা পাইপ বসানোর ফলে জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে পোল্ডারগুলো । এছাড়া গঙ্গা ব্যারেজের কারণে ফারাক্কা বাঁধের জন্য ওপর থেকে পানি আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ওপর থেকে স্বাদু পানির প্রবাহ না থাকায় নদীর লবণাক্ততা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ মেরামতে যে বরাদ্দ পাওয়া যায় তা অপ্রতুল। যেসব এলাকায় বাঁধের অবস্থা খারাপ রয়েছে সেই এলাকাগুলোতে স্টাডি করে টেকসই বেড়িবাঁধ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।