দস্যুরা ফের বেপরোয়া

ছয় বছর আগে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ২০১৮ সালের নভেম্বরে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এখন ফের সুন্দরবনে তৎপর হয়ে উঠেছে বনদস্যুরা। জেলেরা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাতক্ষীরা জেলা কারাগার থেকে পালানো দাগি আসামি এবং ছয় বছর আগে আত্মসমর্পণ করা দস্যুরা সুন্দরবনে গিয়ে ফের শুরু করেছে দস্যুতা। সুন্দরবন-সাতক্ষীরা রেঞ্জে গত আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১৩ জেলে অপহরণের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১০ জেলেকে উদ্ধার করেছে বন বিভাগ।

জেলে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি, মাছ ছিনতাই, চাঁদা আদায়সহ নানা ধরনের অপরাধ তারা করছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে বাড়ি ফিরেছেন সুন্দরবনে বনদস্যু মজনু বাহিনীর হাতে অপহৃত দুই জেলে।

জিম্মিদশা থেকে ফিরে আসা জেলে আতাহার হোসেন (৩৫) ও রুহিন সানা খুলনার কয়রা উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের শফিকুল বিশ্বাস ও রহিম সানার ছেলে। একই বনদস্যু দলের সদস্যরা আতাহার ও রুহিনকে মুক্ত করে দেওয়ার সময় আবু বক্কার গাজী নামে অপর এক জেলেকে জিম্মি করেছে বলে জানা গেছে।

এর আগে, গত ৪ নভেম্বর রাতে সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের চুনকুড়ি নদীর তক্কাখালী এলাকায় বনদস্যুর কবল থেকে ১০ জেলেকে উদ্ধার করে বন বিভাগ। উদ্ধার হওয়া জেলেরা হলেন উপজেলার চুনকুড়ি গ্রামের আলিম গাজী, নূরুল ইসলাম, রবিউল ইসলাম, হাফিজুর রহমান, মফিজুর রহমান, মুছাক সানা, শফিকুল গাজী, নজরুল ইসলাম ও রফিকুল মল্লিক। এ সময় রীতিমতো বন্দুকযুদ্ধ হয় দুই পক্ষের মধ্যে। বনদস্যুদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়ে তিনটি নৌকা, সোলার প্যানেল ও এক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে বন বিভাগ।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সর্বপ্রথম গত ২০ আগস্ট রাত সাড়ে ১২টার দিকে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে শফিকুল গাজী (৪৫) নামে এক জেলেকে অপহরণ করে বনদস্যুরা। পরদিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল হামিদ লাল্টু। তবে গত ১০ নভেম্বর অভিযানে শফিকুল গাজীকে উদ্ধার করে বন বিভাগ।

সম্প্রতি মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা ও বনদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া জেলেদের কাছ থেকে জানা যায়, খুলনার কয়রা, দাকোপ ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত পশ্চিম সুন্দরবনে আসাবুর বাহিনী, শরিফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী ও দয়াল বাহিনী নামে বনদস্যুদের নতুন কয়েকটি দল তৎপরতা শুরু করেছে।

সর্বশেষ ফিরে আসা জেলে আতাহার হোসেন জানান, গত ৮ নভেম্বর সকালে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের হাঁড়িভাঙা থেকে বনদস্যুরা তাদের অপহরণ করে। এ সময় তারা পরিবারের সদস্য এবং মহাজনের মোবাইল নম্বর ও নাম নেয়। সোমবার মুক্তি পেয়ে মঙ্গলবার রাতে তারা হরিনগর এলাকার চুনকুড়ি খাল দিয়ে লোকালয়ে ফিরে আসেন। মুক্তিপণের বিষয়ে তাদের মহাজন জানেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

ফিরে আসা জেলের মহাজন জানান, অপহরণের পর বনদস্যুরা ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। পরবর্তী সময়ে মুক্তিপণের অঙ্ক কমিয়ে ২ লাখ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। ১০ নভেম্বর বিকাশে ২ লাখ টাকা পরিশোধের পর বনদস্যুরা ১১ নভেম্বর রাতে অন্য একটি জেলের নৌকায় তাদের উঠিয়ে দেয়। মঙ্গলবার রাতে তারা পরিবারের কাছে পৌঁছেন।

ফিরে আসা জেলেদের দাবি, ২০১৮ সালে র্যাব-৮-এর হাতে আত্মসমর্পণ করা বনদস্যু মজনু ফের সুন্দরবনের দস্যুতা শুরু করেছে। তিনটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ সাত-আট সহযোগীকে নিয়ে সে ফের জেলে অপহরণসহ মুক্তিপণ আদায়ে তৎপরতা চালাচ্ছে। বিপুল কোম্পানির নৌকা করে তিন সপ্তাহ আগে এসব বনদস্যু সুন্দরবনে প্রবেশ করেছে বলে জানান তারা।

সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের কালিঞ্চি গ্রামের আকবর তরফদারের ছেলে আব্দুল্লাহ তরফদার (৪২) গত ১৪ সেপ্টেম্বর নারী পাচার মামলায় জেলে যায়। গত ৫ আগস্ট রাতে সাতক্ষীরা জেলা কারাগার ভাঙা হলে সেখান থেকে পালিয়ে কৈখালী ইউপির পারাণপুর গ্রামে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ৬ আগস্ট রাতে টেংরাখালী গ্রামের আরও কয়েকজন মিলে মিরগাং মোড় দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে। বনদস্যুতায় নামা আব্দুল্লাহ বাহিনীর প্রধান আব্দুল্লাহর সঙ্গে ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল রয়েছে। তাদের বেশিরভাগ কারাগার থেকে পালানো বলে জানা গেছে।

বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪টি গোলা-বারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিল। পরে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়।

গত ৪ নভেম্বর বন বিভাগের উদ্ধারকৃত জেলেরা জানান, তাদের কয়েকজনকে টগিবগি এলাকা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে দস্যুরা। এরপর হাত-মুখ বেঁধে আটকে রাখে। তাদের পরিবারের কাছে ফোন করে ১ লাখ টাকা করে চাঁদা দাবি করে। এ বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা ৩০ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে পাঠান। পরে একজনকে ছেড়ে দিয়ে বাকি টাকা দিলে অন্যদের ছাড়ার কথা বলে।

জেলেরা জানান, সুন্দরবনে ১০-১২ জনের একটি ডাকাত দল জেলেদের কাছে যা পাচ্ছে সব নিয়ে নিচ্ছে। তারা প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেছেন।

সাতক্ষীরা জেলা কারাগারের ভারপ্রাপ্ত জেল সুপার মোহাম্মদ এনায়েত উল্যা বলেন, ‘কারাগার থেকে পালানোর ঘটনার পর সদর থানায় ৮৭ জন হাজতি ও কয়েদির নামে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩ জন ফিরে আসে। এখনো ৫৪ জন বাইরে রয়েছে। এর মধ্যে দুজন ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত।’

তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ তরফদার মানবপাচার মামলায় গত ১৫ জুলাই শ্যামনগর থানার মাধ্যমে কারাগারে আসে। ৫ আগস্ট রাতে পালিয়ে যায়। এখনো কারাগারে আসেনি। সে হাজতি ছিল।

র্যাব-৬ সাতক্ষীরা ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি কমান্ডার মো. জিয়াদ বলেন, জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ে বনদস্যুদের ব্যাপারে আমি কথা বলেছি। আমরা পুরোনো বনদস্যুদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছি। দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে কেউ নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাইলে কঠোর হাতে তাদের দমন করা হবে। জেলেদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে র্যাব। এ ধরনের কোনো ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অভিযান চালাচ্ছি। নতুন করে কেউ আতঙ্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করলে কঠোর হাতে দমন করব।

বন বিভাগের কদমতলা ফরেস্ট স্টেশনের এসও সোলায়মান বলেন, গত ৩ নভেম্বর সুন্দরবনের চুনকুড়ি নদীর তক্কাখালী এলাকায় অভিযান চালানো হলে বনদস্যু বাহিনীর সদস্যরা বন বিভাগের সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। জবাবে বন বিভাগের সদস্যরাও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এ সময় প্রতিরোধের মুখে বনদস্যুরা পালিয়ে যায়। ধ্বংস করা হয় বনদস্যুদের একটি আস্তানা।

বন কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ বনদস্যুমুক্ত থাকার পর সম্প্রতি ফের বনদস্যুদের কয়েকটি বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই বাহিনীর অত্যাচারে জেলে-বাওয়ালিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ভিন্ন নামে ভিন্ন পরিচয়ে ভারতে বসে এই বনদস্যু গ্রুপটি জেলেদের কাছে মোবাইল ফোনে চাঁদা দাবি করছে বলে জেলে-বাওয়ালিরা অভিযোগ করেছেন।

এ বিষয়ে সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এ জে এড হাছানুর রহমান জানান, বনদস্যুদের অপতৎপরতা প্রতিরোধে সম্প্রতি বন বিভাগ একটি অভিযান পরিচালনা করে ১০ জেলেকে উদ্ধার করে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে অপহরণের কথা শোনা গেলেও আমাদের ভুক্তভোগীর পরিবার তেমন কোনো তথ্য দিচ্ছে না। যে কারণে আমাদের কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা সবসময় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করছি।

Check Also

আসিফ নজরুলকে হেনস্তা, চাকরি হারাচ্ছেন স্টাফ

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিমানবন্দরের সামনে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।