মূল নেতৃত্বে ছিলেন ওয়াসিফুল ইসলাম ছেলে
ওসামা মেয়ে জামাতা আ’লীগ নেতা এরতেজা
স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুরঃ
টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে রাতের অন্ধকারে জুবায়েরপন্থীদের ওপর হামলা ও ট্রিপল মার্ডারের অন্যতম আসামী মাওলানা সা’দ কান্ধলভী অনুসারীদের বাংলাদেশের মুখপাত্র মুফতি মোয়াজ বিন নুরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাকে গতকাল শুক্রবার বিকেলে ৭ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। আগামী রোববার এ রিমান্ড আবেদনের শুনানী হবে বলে জানিয়েছেন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের-জিএমপি দক্ষিণ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার এন এম নাসিরুদ্দিন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে ভারতের নিজামুদ্দিন বা সা’দ অনুসারীদের বাংলাদেশের পরামর্শসভার (কার্যপরিষদ) প্রধান সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামকে ১ নম্বর আসামী করে টঙ্গী পশ্চিম থানায় একটি মামলা দায়ের করেন জুবায়েরপন্থী এস এম আলম হোসেন। মামলায় ওয়াসিফুল ইসলামের ছেলে মুফতি ওসামা ইসলাম আনু এবং মেয়ে জামাতা আওয়ামী লীগ নেতা ড. কাজী এরতেজা হাসানকেও আসামী করা হয়েছে। মামলায় চিহ্নিত মতে মোট ২৯ জনকে এজাহার নামীয় ও অজ্ঞাত আরো কয়েক শ’ সা’দ কান্ধলভী অনুসারীকে আসামী করা হয়। গ্রেফতার মুফতি মোয়াজ বিন নুর ওই মামলার ৫ নম্বর আসামি। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের টঙ্গী পশ্চিম থানার অফিসার ইনসচার্জ (ওসি) ইস্কান্দার হাবিবুর রহমান জানান, গ্রেফতার মোয়াজ বিন নুর (৪০) উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের মরহুম নুর মোহাম্মদের ছেলে। মামলার পরপরই মোয়াজ বিন নূরকে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়।
মামলায় এজাহার নামীয় চিহ্নিত আসামিরা হলেন ঢাকার ধানমন্ডি থানার আবাসিক এলাকার মৃত রিফকুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম, খুলনার বাটিয়াঘাটা উপজেলার বড় কড়িয়া গ্রামের মনসুর রহমানের ছেলে আব্দুল্লাহ মনসুর, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামের ছেলে ওসামা ইসলাম আনু, একই এলাকার ড. কাজী এরতেজা হাসান, উত্তরা এলাকার মৃত নূর মোহাম্মদের ছেলে মোয়াজ বিন নূর, সাভার থানা এলাকার জিয়া বিন কাশেম, তুরাগ থানা (বেলাল মসজিদ) এলাকার আজিমুদ্দিন, সাভার থানার সৈয়দ আনোয়ার আব্দুল্লাহ, মুগদা থানা (বড় মসজিদ) এলাকার শফিউল্লাহ, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজরা এলাকার মৃত মাওলানা মোজাম্মেলুল হকের ছেলে আনাস, মোহাম্মদপুর থানা এলাকার আব্দুল্লাহ শাকিল, রমনা থানার কাকরাইল এলাকার রেজা আরিফ, উত্তরা পশ্চিম থানার (সেক্টর-৯) আব্দুল হান্নান, একই থানার (সেক্টর-১১) রেজাউল করিম তরফদার, তুরাগ থানার (বেলাল মসজিদ) এলাকার মুনির বিন ইউসুফ, ঢাকার সায়েম, হাজী বশির সিকদার, কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার চন্দনপুর গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে মনির হোসেন, মীরপুর থানা এলাকার প্রকৌশলী মুহিবুল্লাহ, ঢাকার পল্লবী থানা এলাকার আজিজুল হকের ছেলে আতাউর রহমান, এলিফ্যান্ট এলাকার তানভীর, তুরাগ থানার ভাটুলিয়া এলাকার মৃত ওয়াজ উদ্দিনের ছেলে বাবুল হোসেন, একই থানা এলাকার প্রকৌশলী আবুল বশর, প্রকৌশলী রেজনুর রহমান, উত্তরা থানার (সেক্টর ১০) মৃত ফজলুল হক সিকদারের ছেলে নাসির উদ্দিন সিকদার, ড. আব্দুস সালাম, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওয়াসি উদ্দিন, রাজধানীর মীরপুর থানা এলাকার মিজান, তুরাগ থানার (বেলাল মসজিদ) এলাকার শাহাদাতসহ কয়েক শ জনকে আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, উল্লেখিত আসামিরা মাওলানা সা’দ কান্ধলাভীর অনুসারী। গত ৪ ও ৭ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমায় বাধা দিয়ে ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য চেষ্টা করে। তারা সরকারকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে সরকারি সিদ্ধান্তবহির্ভূত আগামী ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর টঙ্গী ময়দানে সা’দপন্থিদের জোড় করার মর্মে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রোপাগান্ডা করতে থাকে। মামলার প্রধান আসামি সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম তার সই করা চিঠির মাধ্যমে সারা দেশের সা’দপন্থিদের জানান যে আগামী ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা ময়দানেই পুরনোদের জোড় হবে। ওই চিঠিতে পুরনো সাথিদের সঙ্গে মোনাসেব সাথিদেরও নিয়ে আসে এবং তাদের সঙ্গে যেন টর্চলাইট ও হ্যান্ডমাইক থাকে এমন নির্দেশনা দেয়া হয়।
মামলার ২ নম্বর আসামি আব্দুল্লাহ মনসুর ফেসবুক লাইভে ঘোষণা দেন, পুরনোদের জোড়ে এবং বিশ্ব ইজতেমায় যদি মাওলানা সা’দ সাহেবকে আনতে দেওয়া না হয় এবং তাদের যদি টঙ্গী ময়দানে ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর জোড় করতে দেওয়া না হয়, তাহলে তারা সরকারের সিদ্ধান্তমতে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব হতে দেবে না।
তাদের এসব উসকানিমূলক বক্তব্যে ও নির্দেশে বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) রাত ৩টার দিকে ঘুমন্ত ও পাহারারত শুরায়ী নেজামের সাথিদের ওপর হামলা করে। তাদের হামলায় কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্দু গ্রামের মৃত ওসমান গণির ছেলে আমিনুল ইসলাম বাচ্চু (৬৫), ফরিদপুর সদর উপজেলার কমলাপুর গ্রামের মৃত শেখ সামাদের ছেলে বেলাল হোসেন (৬০) এবং বগুড়া সদর উপজেলার ধাওয়াপাড়া গ্রামের ওমর উদ্দিনের ছেলে তাজুল ইসলামকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে।
কে এই ওয়াসিফুল ইসলাম ঃ তাবলীগ জামাত সূত্রে জানা গেছে, সাদপন্থীদের শীর্ষ মুরুব্বী ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনামের ভগ্নিপতি। ওয়াসিফুল ইসলামের মেয়ে জামাতা নৌকা প্রতিক নিয়ে নির্বাচন করা বিতর্কিত শিল্পপতি ড. কাজী এরতেজা হাসানও সাদপন্থীদের অন্যতম শীর্ষ নেতা। কাজী এরতেজা শেখ হাসিনার ধর্মচিন্তা বইয়ের লেখক। এরতেজা হাসান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক উপকমিটির সদস্য, সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত), বর্তমান সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক, ভোরের পাতা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান, দৈনিক ভোরের পাতা ও দি পিপলস টাইমসের সম্পাদক ও প্রকাশক। জালজালিয়াতি ও প্রতারণার মামলায় কাজী এরতেজা ২০২২ সালের ১ নভেম্বর খিলক্ষেত থানার এক মামলায় পিপিআই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। সৈয়দ ওয়াসিফুল ইলামের পুত্র বা ড. এরতেজা হাসানের শ্যালক মুফতি ওসামা ইসলামও সাদপন্থীদের অন্যতম আরেক নেতা। বাব-বেটা-জামাতা তিন জনই সা’দপন্থীদের নেতৃত্ব দিয়ে বিশাল ইজতেমা ময়দান দখলে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তাবলীগ জামাতে বিভক্তি শুরুর বহু আগে থেইে ওয়াসিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন, তাবলীগকে রাজনীতিকরণের অভিযোগ ছিল। ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি ওয়াসিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে তাবলীগ জামাতের একটি অংশ (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম মুশফিকুর রহমান চৌধুরীর সমর্থকরা) জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। তাতে ওয়াসিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে কাকরাইল মসজিদ নির্মাণের নামে দেশে-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা থেকে ২০০ কোটি টাকা তুলে আত্মসাতের অভিযোগ করেন। ওয়াসিফুল ইসলামের ছেলে ওসামা ইসলাম বিদেশ থেকে এসব টাকা সংগ্রহে সহায়তা করেন বলে ওই সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়। তাবলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে ওয়াসিফুল ইসলামের চঁাদাবাজি ও রাজনীতি তথা তাবলীগের মূলনীতির পরিপন্থি কর্মকাণ্ডের কারণেই মূলত তাবলীগ জামাতে দ্বিধাবিভক্তি শুরু হয় বলে অনেকে মনে করেন।