মেজরিটি–মাইনরিটি মানি না, এ দেশের নাগরিক প্রত্যেকে সমমর্যাদাবান: ডা শফিকুর রহমান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা সাফ বলেছি, মেজরিটি-মাইনরিটি মানি না। এ দেশের নাগরিক প্রত্যেকে সমমর্যাদাবান। ছোট্ট একটা দেশ, এত ভাগ কিসের আবার। জাতীয় স্বার্থে আমরা সবাই এক। কারণ, দেশ বাঁচলে আমিও বাঁচব, সবাই বাঁচবে। অশান্তি হলে সবাইকে তা ভোগ করতে হবে। আমরা একটা শান্তিপূর্ণ মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই।’

গতকাল শনিবার রাতে সিলেট মহানগর জামায়াতের উদ্যোগে হিন্দু–বৌদ্ধ–খ্রিষ্টান ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে জামায়াতের আমির এসব কথা বলেন। নগরের জিন্দাবাজারের একটি অভিজাত হোটেলের সম্মেলনকক্ষে এই মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন পর্যায়ের ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বিপুলসংখ্যক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।

সভায় জামায়াতের আমির বলেন, ‘আমরা কোনো দায়িত্ব পেলে মালিক হিসেবে নয়, পাহারাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করব। আমাদের নেতা-কর্মীদের আগে যে সম্পদ থাকবে, নির্বাচনের পরও সমান সম্পদ থাকবে। নিজের দিকে না তাকিয়ে জনগণের দিকে তাকাতে হবে। আমাদের কর্মীদের স্পষ্ট বলা হয়েছে, কারও সম্পদের দিকে তাকানো যাবে না। যদি এ রকম কোনো ঘটনা ঘটে, আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।’

ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘৫ আগস্টের আগে দেশে দখলদারি-চাঁদাবাজি হয়েছে, এখনো হচ্ছে। শুধু ফ্ল্যাগ বদল হয়েছে, ডান হাত থেকে বাম হাতে গেছে। স্বাধীনতার পর থেকে সব ধর্মের মানুষকে সরকারি দলের বাড়াবাড়ির শিকার হতে হয়েছে। একসময় দেশে ইসলাম ছাড়া যে পরিমাণ ভিন্ন ধর্মের মানুষ ছিলেন, সেই হার এখন আর নেই। ইসলাম ছাড়া ভিন্ন ধর্মের মানুষের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। ভিন্ন ধর্মের মানুষ কমে যাওয়ার দুটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁরা সম্মানের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। অন্যটি হলো হয়তো বা জন্মের হারে তারা পিছিয়ে রয়েছেন। স্বাধীনতার পর কোনো সরকারের আমলে বাড়াবাড়ি কোথাও থামেনি। সেই বাড়াবাড়ির শিকার সুনির্দিষ্ট কোনো ধর্মের মানুষ হয়নি, সব ধর্মের মানুষকে হতে হয়েছে।’

আমিরে জামায়াত বলেন, ‘বিগত সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সম্প্রদায়, পক্ষ-বিপক্ষ উপস্থাপন করে নিজ নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেছে। জুলাই বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে আমরা বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে চাই। সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা অধিকাংশ ভারতীয় মিডিয়ার অপপ্রচার। কিছু ঘটনা ঘটেছে রাজনৈতিক কারণে, তবে তা–ও আমরা সাপোর্ট করি না। আইনের ভিত্তিতে সবাইকে চলা উচিত। মানুষ মানুষের জন্য। মানুষ মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করবে, কোনো ধর্ম হিসেবে কাউকে বিবেচনা করা উচিত না। আমরা প্রাইমারি থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত হিন্দু–বৌদ্ধ–খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ পাশাপাশি বেঞ্চে বসি। যুগ যুগ ধরে আমরা এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষের সামাজিক অনুষ্ঠানে যাই। কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনায় ধর্ম দায়ী নয়।’

ডা. শফিক আরও বলেন, ‘শেখ মুজিব রহমান ১৯৭২ সালে বললেন, এ দেশে যারা থাকবেন তাদের বাঙালি হয়েই থাকতে হবে। এরপরই পাহাড়ে ঝামেলা শুরু হলো, যা এখনো রয়েছে। ধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় না। আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখব। এ দেশকে গড়ে তুলতে সবার অবদান রয়েছে।’

জামায়াতপ্রধান বলেন, ‘জামায়াতই একমাত্র সংগঠন, যারা নিজেদের সদস্যদের মাসিক চাঁদায় চলে। একজন নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর সম্পদ কমবে, আমরা এমন বাংলাদেশ চাই। রাজনীতিকে অনেকে ব্যবসা বানিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘৫ তারিখ আমরা দলের সব নেতা-কর্মীকে সব ধর্মের প্রতিষ্ঠান পাহারা দিতে বলেছি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। দুর্গাপূজার সময় আমরা সহযোগিতা করেছি। এখন অনেকে চাঁদাবাজি করে, দখলবাজি করে। আমরা কারও সম্পদের দিকে হাত বাড়াতে না করেছি। যেসব দাবি দাওয়া আপনারা করেছেন, তা দেখব এবং সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলব।’

সিলেটে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জামায়াতের মতবিনিময়। ছবি: আজকের পত্রিকাসিলেটে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জামায়াতের মতবিনিময়। ছবি: আজকের পত্রিকা

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সিলেট মহানগর আমির মুহাম্মদ ফখরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এবং সেক্রেটারি মোহাম্মদ শাহজাহান আলীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের।

মতবিনিময় সভার শুরুতে বক্তব্য দেন সিলেট রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী চন্দ্রনাথানন্দজী মহারাজ, সিলেট বৌদ্ধবিহারাধ্যক্ষ শ্রীমৎ সংঘ্যানন্দ মহাথের, সিলেট প্রেসবিটারিয়ান মিশনমণ্ডলীর সভাপতি ডিকন নিঝুম সাংমা, সিলেট জেলা পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি গোপীকা শ্যাম পুরকায়স্থ, বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মৃত্যুঞ্জয় ধর ভোলা, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মলয় পুরকায়স্থ, সিলেট জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বিজয় কৃষ্ণ বিশ্বাস, বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক রজত কান্তি ভট্টাচার্য, সিলেট মহানগর পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রদীপ দেব প্রমুখ।

এ সময় হিন্দু–বৌদ্ধ–খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নেতারা বলেন, ‘৫ আগস্টের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। জামায়াত নেতৃবৃন্দ সঙ্গে থেকে আমাদের সান্ত্বনা দিয়েছেন। ইসলাম ধর্মে বাজে লোকদের জায়গা নেই। আমরা ধর্মীয়ভাবে সহনশীল হব, রাজনৈতিক বিষয় রাজনীতিবিদেরা বুঝবেন। বিগত সরকারের আমলে আমাদের কিছু দাবিদাওয়া ছিল, তারা তা মেনে নেয়নি। সংখ্যালঘুদের কোনো ফাউন্ডেশন দেওয়া হচ্ছে না। কল্যাণ ট্রাস্ট করে রেখেছে। সংখ্যালঘুরা নাগরিক অধিকার পাচ্ছে না। দ্রুত নির্বাচন দেওয়া উচিত। দেবোত্তর সম্পত্তিসহ আমাদের আটটি দাবি বর্তমান সরকারকে মেনে নেওয়ার জন্য জামায়াত আমিরের সহযোগিতা কামনা করছি।’

Check Also

গাজায় আরও ৭৭ ফিলিস্তিনি নিহত

ইসরায়েলি বর্বর হামলায় গাজা ভূখণ্ডে আরও ৭৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।এতে করে উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।