বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্পষ্ট বার্তা ‘আগে বিচার ও সংস্কার’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা বলেছেন, ‘যারা হাসিনার মতো স্বৈরাচারকে বিতাড়িত করতে পেরেছে, তারা দেশও চালাতে পারবে। তরুণেরা পেরেছে, পারবে। স্বৈরাচারের দোসরদের জায়গা এ দেশে আর হবে না।’

তারা বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের বিচার ও দেশ সংস্কারের আগে কোনো নির্বাচন হবে না।’

মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচিতে এসব কথা বলেন নেতারা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সাধারণ জনতা ও শিক্ষার্থীদের ঢল নামে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায়। সমাবেশস্থল পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। মিছিল আর স্লোগানে উত্তাল ঢেউ খেলে। শহীদ মিনার এলাকায় সরেজমিনে এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। অনুষ্ঠান বিকেল ৩টায় হওয়ার কথা থাকলেও শুরু হয় এক ঘণ্টা পর।

এক মিনিট নীরবতা পালন হয় জুলাই-আগস্টের শহীদদের স্মরণে। মঞ্চের দু’পাশে আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পরিবারের জন্য সংরক্ষিত জায়গা রাখা হয়।

মঞ্চ থেকে থেকে মাইকে স্লোগান দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। স্লোগান দেন ‘ক্ষমতা না জনতা? জনতা, জনতা; গোলামী না আজাদী? আজাদী, আজাদী; দিল্লি না ঢাকা? ঢাকা, ঢাকা; মুজিববাদ মুর্দাবাদ, মুজিবাদী সংবিধান থাকবে না রে থাকবে না; ২৪ এর বাংলায় মুজিবাদের ঠাঁই হবে না; জুলাইয়ের প্রেরণা দিতে হবে ঘোষণা, এই মুহূর্তে দরকার, বিচার আর সংস্কার’ ইত্যাদি।

সমাবেশে আগত সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের হাতে জুলাই-আগস্টের স্মৃতি ধারণ করে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার দেখা গেছে।

সমাবেশে প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। এতে ২০০৯ সালের পিলখানার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে, ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে হেফাজতের কর্মীরা ওপর নৃশংস হামলার ঘটনা দেখানো হয়েছে, গুম হয়ে যারা ফিরে এসেছেন, তাদের বিবরণ, আয়নাঘরের বিবরণ, গুম হওয়া পরিবারের আর্তনাদ, ক্ষোভ ও দাবি তুলে ধরা হয়েছে। সেইসাথে গুম বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন ‘মায়ের ডাকের’ ভূমিকা এবং গত ১৬ বছর বিএনপির ওপর কিভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন করা হয়েছে সেটিও ফুটে উঠেছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত, ৫ জুন কোটাবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে প্রথম ব্লকেড কর্মসূচি, এরপর সরকারের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনতার ফুঁসে উঠা, এক দফার মাধ্যমে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন- এসব ওঠে এসেছে প্রামাণ্যচিত্রে।

স্লোগানের ফাঁকে ফাঁকে নেতারা বলেছেন, ‘যারা জুলাই-আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের আগে অন্যকিছু চায়, তারা গণঅভ্যুত্থানের শত্রু। পাবলিক, প্রাইভেট, মাদরাসার কোনো ভাইকে আমরা ভুলি নাই, আমরা সবাই মিলে গণঅভ্যুত্থান করেছি।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচার এখনো নিশ্চিত করতে পারিনি। শাপলা চত্বরে লাইট নিভিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের হত্যা করা হয়েছে ১৩ সালে, বিডিআর বিদ্রোহের নামে দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছে, এর বিচার করতে হবে। আমাদের একমাত্র শত্রু আওয়ামী লীগ।’

সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘১৫ জানুয়ারি মধ্যে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের প্রক্লেমেশন দিতে হবে।’ এ দাবিতে আবার ১৫ জানুয়ারি সবাই রাস্তায় নামবে- এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।

জাতীয় নাগরিক কমিটি আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ‘আমরা পৃথিবীর মানচিত্রে এক নতুন বাংলাদেশ দেখতে চাই। যেখানে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি হবে না। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের প্রোক্লেমেশনে এমন লিপিবদ্ধ চাই।’

ফ্যাসিস্টদের বিলোপে সরকারকে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘না হলে বিপ্লবীরা আইন হাতে তুলে নিবে।’

জাতীয় নাগরিক কমিটি সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘জানুয়ারির ১৫ তারিখে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রোক্লেমেশন করতে হবে। এদেশের মানুষ নতুন সংবিধান চায়।’

‘আগামী নির্বাচন হবে গণপরিষদ নির্বাচন,’ জানান তিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ‘৫ জুন থেকে ৫ আগস্ট কি আমাদের শেষ হয়েছে? হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের শহীদ ভাইদের যারা রক্ত নিয়েছে, তাদের বিচার না করতে পারলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। প্রত্যেক সেক্টরের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। কেউ যদি স্বপ্ন নিয়ে প্রাণ দেয়া শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানী করে, তার সমূলে উৎপাটন করব।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উম্মা ফাতেমা বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বিচারের আগে কোনো নির্বাচন হবে না। কথা পরিষ্কার। জুলাই মরে যায়নি, আমরা জুলাইয়ের স্পিরিট নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। একাত্তরের মতো এ গণঅভ্যুত্থানকে আমরা ব্যর্থ হতে দেব না।’

শহীদ মীর মুগ্ধর বাবা বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বতী সরকার পরও তিন মাস ওবায়দুল কাদের কার হেফাজতে ছিলেন, কে তাকে ভারতে পালাতে সুযোগ করে দিলো, জানতে চাই। যারা পালাতে সুযোগ করে দিয়েছে তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে, বিচার করতে হবে।’

জুলাইয়ের বিপ্লবীদের ‘জাতীয় বিপ্লবী’ হিসেবে স্বীকৃত দেয়ার দাবি জানান তিনি।

আওয়ামী লীগের আমলে জেলখাটা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কোবরা বলেন, ‘আমি হাসিনার বিচার চাই, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ চাই।’

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ‘সরকারকে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রক্লেমেশন দিতে হবে। বিচার আর সংস্কার শেষ না করে বিপ্লবীরা রাজপথ ছেড়ে যাবে না।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা কলেজ প্রতিনিধি মো: রাকিব বলেন, ‘৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সাথে আমরা ভারতকেও কিক মেরে আউট করেছি। জুজুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। শুধু নির্বাচনের জন্য এত মানুষ প্রাণ ও রক্ত দেয়নি। নির্বাচনের কথা বলে কেউ যদি টেন্ডার ও চাঁদাবাজিতে জড়াতে চায়, শেখ হাসিনার মতো তাকেও পালাতে বাধ্য করবো।’

‘বিচার ও সংস্কারের আগে নির্বাচন নয়,’ বলেন তিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, ‘খুনিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন? খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেরাচ্ছে।’ বিচার আর সংস্কারের দাবিতে জাতিকে আরেকবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রিফাত রশিদ বলেন, ‘খুনি হাসিনাকে নিয়ে এসে অতি দ্রুত বিচার করতে হবে। আমরা বাংলাদেশকে বিনির্মাণ না করা পর্যন্ত রাজপথ ছাড়ব না।’

সমন্বয়ক খান তালহা মাহমুদ রাফি বলেন, ‘যারা আমাদের ভাই-বোনকে হত্যা করেছে তাদের চুল পরিমাণ ছাড় নয়।’ প্রয়োজনে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তবুও মুজিববাদি সংবিধানের কবর রচনা করব।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি ও কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আসাদ বিন অলি বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, যারা ১৫ বছর আমাদের রক্ত চুষে খেয়েছে, একটি গোষ্ঠী তাদেরকে শেল্টার দিতে চায়। আমরা সেই শেল্টারদাতাদের বিষদাঁত ভেঙে দেব।’

শহীদ শাহারিয়া হাসান আলভির বাবা বলেন, ‘খুনিদের বিচারের করলেই শহীদ পরিবারের মানুষেরা শান্তি পাবে। শহীদ পরিবারের দুঃখ-কষ্ট একমাত্র শহীদ পরিবাররাই বোঝে।’

সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দুর্বল ভাববেন না, এখনো আমরা বিচারের কিছু দেখতে পাইনি। আমাদেরকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করবেন না।’

Check Also

জিয়াউর রহমানের নাম নিলে বেহেশত নিশ্চিত, বললেন বিএনপি নেতা

কুমিল্লা অফিস: বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নাম প্রতিদিন নিলে বেহেশত নিশ্চিত বলে মন্তব্য করেছেন দলটির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।