হাজারো শহীদের রক্তবন্যা বইয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পলায়ন

কোটাবৈষম্য নিয়ে আন্দোলন শুরুর ২০ দিনে লাশ আর রক্তবন্যায় পতন ঘটে দেড় দশকের ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বছরের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, শেষমেশ তা গড়েছে বাংলাদেশে স্বাধীনতার সত্যিকার ইতিহাস। ছাত্র-জনতার ৩৬ দিনের সেই আন্দোলনে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালাতে বাধ্য হন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী এ আন্দোলন পরে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন
২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের জারি করা পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণার পরপরই মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলন হিসেবে এর সূচনা হয়। এর আগে বাংলাদেশের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটাপ্রথা বাতিল করে সে ব্যবস্থা পুনর্মূল্যায়ন করতে হাইকোর্টে ৩১ জানুয়ারি একটি রিট করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও কুমিল্লা সাংবাদিক ফোরামের কয়েকজন নেতৃবৃন্দ। আবেদনে তারা উল্লেখ করেন, “সব মিলিয়ে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা বিদ্যমান রয়েছে যা চরম বৈষম্যপূর্ণ। পরদিন ৬ জুন আদালতের রায়ের প্রতিবাদে ও কোটা বাতিলের দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। ৯ জুন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে। ১০ জুন আন্দোলনকারীরা দাবি মেনে নিতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন ও ঈদুল আজহার কারণে আন্দোলনে বিরতি ঘোষণা করেন। ৩০ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটাবিরোধী রায়টি পুনর্বহালের দাবিতে মানববন্ধন করেন। এভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

ঐতিহাসিক জুলাই আন্দোলনের সূচনা
১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা সংক্রান্ত আদালতের রায়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন এবং তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। একইদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন। ২ থেকে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করেন। ৭ জুলাই শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’-এর ডাক দেন যার আওতায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করেন। ৮ ও ৯ জুলাই একই রকম কর্মসূচি পালন করা হয়।
১০ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয়ে শাহবাগে গিয়ে স্থানটি অবরোধ করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শিক্ষার্থীদের সামনে ব্যারিকেড দিয়ে অবস্থান করে। দুপুরে জানা যায়, কোটাব্যবস্থা বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতি শিক্ষার্থীদের ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেন। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবরোধের কারণে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থা স্তিমিত হয়ে আসে। দূরপাল্লার বাসগুলো আন্দোলনের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ১১ জুলাই বিকেল ৩টা থেকে শাহবাগ অবরোধের কথা থাকলেও বৃষ্টির কারণে শিক্ষার্থীরা শাহবাগে যাওয়ার পথে পুলিশের বাধাকে অতিক্রম করে ৪:৩০টায় তা শুরু করেন। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা পুলিশি বাধার ফলে পিছিয়ে যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে শাহবাগে যোগ দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শাহবাগ ছাড়া ঢাকার অন্য স্থানগুলো আন্দোলনের প্রভাবমুক্ত ছিল। রাত ৯টায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শেষ করে তাদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে ১২ জুলাইয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা দেন। এদিন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ ও পুলিশ। ১২ জুলাই বিকেল ৫টায় শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের সতর্কবাণী উপেক্ষা করে শাহবাগে জড়ো হয়ে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। এই দিনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতে থাকলে ছাত্রলীগের একদল কর্মী আক্রমণ করে। এ সময় সে অবস্থায় ভিডিও করায় কলেজের এক শিক্ষার্থীকে তুলে হলে নিয়ে বেধড়ক মারধর করে ছাত্রলীগের কর্মীরা। একই দিন বিকেল ৫টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন বাজারসংলগ্ন ঢাকা-রাজশাহী রেললাইন অবরোধ শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। এতে সারা দেশের সঙ্গে রাজশাহীর রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৩ জুলাই রাজশাহীতে রেলপথ অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। রাজধানীতে ঢাবি শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করেন। তারা অভিযোগ করেন, “মামলা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বন্ধের চেষ্টা করা হচ্ছে”। এদিন বগুড়া শহরের পৌর এডওয়ার্ড পার্কের শহীদ টিটু মিলনায়তনে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, “কোটা সরকার পুনর্বহাল করেনি। সুপ্রিম কোর্ট সেটি স্থগিত করেছে। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে বা বিচারাধীন বিষয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। তাহলে আদালত অবমাননা হবে। এসব বুঝেও যারা জনভোগান্তি ঘটাচ্ছেন, সেই ভোগান্তি যাতে না ঘটে, সেজন্য সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বদ্ধপরিকর এবং আশা করব, শিক্ষার্থীরা সুপ্রিম কোর্টের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন।
১৪ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকায় গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন। এদিন শেখ হাসিনার এক বক্তব্য ঘিরে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। শেখ হাসিনার চীন সফর শেষে ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা-সুবিধা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?’ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবিকে তাচ্ছিল্য করে শেখ হাসিনার দেওয়া এ বক্তব্যে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। ওইদিনই গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ করেন ছাত্রছাত্রীরা। ওইদিন গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় মিছিল বের হয়। ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান উঠলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে। ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীরা আবার বিক্ষোভে নামলে হামলা করে ছাত্রলীগ। দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্য অপমানজনক। এ বক্তব্য আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “গত রাতে বিক্ষোভ করে আমরা সোমবার ১২টার প্রধানমন্ত্রীকে তার বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলাম। প্রত্যাহার না হওয়ায় আমরা রাস্তায় নেমেছি”।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, কোটা সংস্কারে সরকারকে দেয়া দাবি না মানা পর্যন্ত তাদের এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। সেদিন বহিরাগতদের এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ওপর ন্যক্কারজনক আক্রমণ করে ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠন)। এরপর গোয়েন্দাদের দিয়ে ছাত্র সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে নির্যাতন করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করা হয়। ১৫ জুলাই আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পরদিন দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৬ জুলাই থেকে পুলিশ গুলি করতে শুরু করে। ওইদিন ঢাকার সায়েন্সল্যাব ও নিউমার্কেট এলাকায় পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় শিক্ষার্থীদের। সেখানে দুজন মারা যান। তবে ওইদিন রংপুরে প্রকাশ্যে আবু সাঈদের মৃত্যু দেশজুড়ে ছাত্র আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দাঁড়ান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র অকুতোভয় আবু সাঈদ। একের পর এক গুলিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। এ ঘটনার ভিডিও গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। সাথে যোগদান করে অভিভাবক ও সাধারণ শিক্ষক নেতৃবৃন্দ। আন্দোলন দমাতে পুলিশের পাশাপাশি নামানো হয় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র দলীয় কর্মীদের। এদিন রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা এ সড়ক অবরোধ করেন। এতে ওই সড়কসহ রাজধানীর একাংশ অচল হয়ে পড়ে, যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ভাটারা এলাকার প্রগতি সরণি ও কুড়িল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। ১৬ জুলাই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগের হামলার ভয়ে উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে আশ্রয় নেন। রাত সোয়া ২টার দিকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সেখানে ঢুকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মারধর করে। এর আগে রাত ১২টার পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়। এতে বহিরাগতসহ ছাত্রলীগের দেড় শতাধিক ক্যাডার অংশ নেয়। এ হামলায় অনেক সাধারণ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আহত হন।
দেশজুড়ে কারফিউ জারি ও ইন্টারনেট বন্ধ
আন্দোলন তীব্র আকার করলে অবস্থা বেগতিক দেখে ১৭ জুলাই বন্ধ করে দেওয়া হয় আন্দোলনের কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর হলগুলো। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ করে সরকার। ১৯ জুলাই কারফিউ জারি করে সরকার এবং দেশজুড়ে বন্ধ করে দেয় ইন্টারনেট। ওইদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন, ‘শুট অ্যাট সাইট’ (দেখামাত্র গুলি)-এর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি মাঠে নামেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নেমেছিলেন স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থীসহ শ্রমজীবী মানুষ। আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ান শিক্ষক, অভিভাবক ও এলাকাবাসী। আন্দোলনে যুক্ত হন তখনকার বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কর্মীরাও। তখন আন্দোলনটি ছাত্র-জনতার ব্যাপকভিত্তিক গণআন্দোলনে রূপ নেয়। রাজধানীসহ গুরুত্বপূর্ণ শহর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে বিপুল পরিমাণে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও সেনা মোতায়েন করে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্বিচার গুলির মধ্যেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে জেলা-উপজেলা পর্যন্ত। নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তখন পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃত্যুর তথ্য গোপন করছিল। ইন্টারনেট বন্ধ রেখে এবং সাধারণ সরকারি ছুটি ঘোষণা করে এ সময় আন্দোলন স্তিমিত করার চেষ্টা করা হয়। সেনাবাহিনীকে দেশের বিভিন্ন অংশে কারফিউর অংশ হিসেবে টহল দিতে দেখা যায়। দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল রেখে পুনরায় কারফিউ শুরু হয়। রোববার (২১ জুলাই ২০২৪) ও সোমবার (২২ জুলাই ২০২৪) বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এদিকে ২৪ জুলাই সীমিত পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালুর অনুমতি দেয়া হলেও মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ থাকে। পঞ্চম দিনের মতো সারা দেশে কারফিউ বলবৎ ছিল। এদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের মৃত্যু হয় ও নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৭ হয়। তবে শিক্ষার্থীদের মতে প্রকৃত নিহতের সংখ্যা আরও অনেকগুণ বেশি হবে বলে দাবি করা হয় যা ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় জানা যায়নি। আর এদিন বিভিন্ন মামলায় পুলিশ ১,৭৫৮ জনকে গ্রেফতার করে। এছাড়া বিক্ষোভের সময় সেনা মোতায়েনের পর জাতিসংঘের লোগোসংবলিত যান ব্যবহৃত হলে জাতিসংঘ এ নিয়ে উদ্বেগ জানায়। প্রতিদিনই সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নৃংশতায় একের পর এক ছাত্র-জনতার হতাহতের খবর আসতে থাকে। ২৭ জুলাই আহত চিকিৎসাধীন তিন সমন্বয়ককে ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। পরে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদসহ আটক সকল শিক্ষার্থীদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও শিক্ষার্থী গণহত্যার সাথে জড়িত মন্ত্রী পর্যায় থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সকল দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আলটিমেটাম দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। ৩০ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে কোটা আন্দোলনকে ঘিরে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে দেশব্যাপী শোক পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকার ঘোষিত শোক দিবসকে প্রত্যাখ্যান করে শোকের কালো রং বাদ দিয়ে আন্দোলনকারী এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিবর্গ, সাধারণ নাগরিক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একটি বড় অংশ; এমনকি সাবেক সেনাপ্রধানও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাল প্রোফাইল ছবির মাধ্যমে কোটা আন্দোলনকারীদের সাথে সমর্থন জানান।
এদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ১ আগস্ট বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্বাহী আদেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারা অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে সরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২ আগস্ট শুক্রবার ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
৩ আগস্ট সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা
সারা দেশে যখন একের পর এক নিহতের সংখ্যা বাড়ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের হামলা-মামলা চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে ৩ আগস্ট সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা দিয়ে পরদিন সারা দেশে অসহযোগ কর্মসূচি দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ৪ আগস্ট অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে মাঠে নামার ঘোষণা দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সারা দেশে ব্যাপক সংঘাতে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়। নিহতদের মধ্যে অন্তত ১৪ পুলিশ সদস্য ছিলেন। শাহবাগে ব্যাপক জমায়েতের মধ্যে পরদিন ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কর্মসূচি ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে গুলি চালায়। ওই এক দিনেই সারা দেশে শতাধিক ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। উত্তাল সেই পরিস্থিতিতে ঘোষণা আসে ছাত্র-জনতার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির। সমন্বয়ক আসিফ ভিডিও বার্তায় সারা দেশের ছাত্র-জনতাকে ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্ট ঢাকামুখী পদযাত্রার আহ্বান জানান।
‘৩৬ জুলাই’
গণভবন অভিমুখে ছাত্র-জনতার যাত্রা, ফ্যাসিস্ট হাসিনার ভারত পলায়ন
৫ আগস্ট সকাল থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। গাজীপুর-উত্তরা এলাকা থেকে আসতে থাকে বিশাল বিশাল মিছিল। যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ ও শাহবাগ থেকে আরও মিছিল আসতে থাকে। মিছিলে মিছিলে পুরো রাজধানী মানুষের জনস্রোতে পরিণত হয়। সবার গন্তব্য ছিল গণভবন ও জাতীয় সংসদ ভবন অভিমুখে। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে গণভবন থেকে বের করার জন্য। খুনি হাসিনা সেনাবাহিনীকে গুলি করার নির্দেশ দিলেও সেনাবাহিনী তাতে অস্বীকার করে। এদিন দুপুর নাগাদ শেখ হাসিনার পতনের কথা শোনা যায়। সাধারণ মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার দেখে এ জনস্রোত গণভবনে পৌঁছানোর আগেই শেখ হাসিনা ভারতের সাথে যোগসাজশের ভিত্তিতে সামরিক বাহিনীর একটি বিমানে করে দুপুরে ছোট বোন শেখ রেহানাকে সাথে নিয়ে দেশ ছাড়েন। এরপর বিক্ষুব্ধ জনতা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবন ও সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে, চালায় ব্যাপক লুটতরাজ। শত শত ছাত্র-জনতার লাশ আর রক্তের ওপর দিয়ে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালান। বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্রক্ষমতায় এক টানা এত বছর জগদ্দল পাথরের মতো টিকে ছিলেন হাসিনা। আর দেশের ইতিহাসে রাতে ভোট নেয়া এবং ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পলায়নের ইতিহাসও তৈরি করেন তিনি। ছাত্ররা বলেছিল, জুলাই মাসেই শেখ হাসিনাকে বিতাড়িত করবে তারা। ৩১ জুলাইয়ের পর থেকে তারা নতুন হিসাব শুরু করে; সেই হিসাবে ৫ অগাস্ট ছিল ‘৩৬ জুলাই’।

Check Also

বাগেরহাট কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন ৬৪ ভারতীয় জেলে

বাগেরহাট জেলা কারাগার থেকে ৬৪ জন ভারতীয় জেলে মুক্তি পেয়েছে। বুধবার (২ জানুয়ারি) দুপুরে তাদের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।