আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরনের খাল বা নদীর ধারে হরহামেশাই চোখে পড়ছে দল বেঁধে হরিণের চলাফেরার দৃশ্য। বন্যপ্রাণীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে সুন্দরবন আরও প্রাকৃতিক হয়ে ওঠেছে। এদিকে হরিণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতে সুন্দরবনে আকর্ষণ বাড়ছে পর্যটকদের। এখন সুন্দরবনের খালের পাশে, পর্যটক এলাকায় প্রচুর হরিণ দেখতে পাওয়া যায়, যা পর্যটকদের আরও বেশি আকর্ষিত করে। পর্যটক, দর্শনার্থী এবং স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সাম্প্রতি সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা বেড়েছে। সুন্দরবনের বাঁকে বাঁকে এখন হরিণের দেখা মেলে। বনের খাল বা নদীর ধারে দলবেঁধে হরিণের চলাফেরা করছে। এদিকে সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা বাড়লেও শিকার বন্ধ করা যাচ্ছে না। বনসংলগ্ন এলাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে শিকারিরা। বন বিভাগ ও পুলিশের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৫০ শিকারিকে হরিণের মাংস ও চামড়াসহ আটক করা হয়েছে। সুন্দরবনসংলগ্ন বাসিন্দারা জানান, যে পরিমাণ হরিণের মাংস ও চামড়া আটক হয়, তার থেকে কয়েকগুণ বেশি পরিমাণ হরিণ শিকার করা হয়। মাঝেমধ্যে দু—একটি অভিযানে হরিণের মাংস, চামড়া, মাথা উদ্ধার হলেও মূল শিকারি ও পাচারকারীদের কেউ আটক হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হরিণের মাংস বহনকারীরাই ধরা পড়ে। হরিণ শিকারি চক্তের অনেকে যুবদলের সদস্য বলে বণরক্ষীরা জানান।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, সুন্দরবনের বুক চিরে বয়ে চলা নদীর পাশে ছুঁটে বেড়াচ্ছে হরিণ, দৌড়ে আবার যাচ্ছে বনের ভেতর। এমন দৃশ্য এখন নিয়মিত চোখে পড়ে প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি সুন্দরবনে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) জরিপের তথ্য মতে, বর্তমানে সুন্দরবনে ১ লাখ ৩৬,৬০৪টি হরিণ রয়েছে। এর আগে ২০০৪ সালে হরিণের সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার। সেই হিসেবে ১৯ বছরের ব্যবধানে সুন্দরবনে হরিণ বেড়েছে ৫৩,৬০৪টি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় কয়েকটি চক্র অনেক আগে থেকেই হরিণ শিকারে জড়িত। তবে বর্তমানে তা ব্যাপক হারে বেড়েছে। সুন্দরবনসংলগ্ন উপজেলা ও আশপাশের এলাকায় হরিণের মাংসের দাম কম হওয়ায় চাহিদাও বেড়ে গেছে। এ সুযোগে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চোরা শিকারিরা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বন বিভাগের কিছু অসৎ কর্মকর্তা—কর্মচারীর যোগসাজশেই জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার পারমিট নিয়ে বনে ঢুকে চোরা শিকারিরা হরিণ শিকার করে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে এজেন্ট ব্যবসায়ীদের। এ এজেন্টদের মাধ্যমে কখনো অগ্রিম অর্ডার, আবার কখনো মাংস এনে তারপর বিক্রি করা হয়। এ চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায় হরিণের মাংস। অভিযানে আটক হরিণ শিকারিদের দেয়া তথ্যমতে, বনের পাশে যাদের বাড়ি, তারাই বেশি হরিণ শিকারের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর এবং বাগেরহাটের মোংলা ও শরণখোলা উপজেলার মানুষ বেশি হরিণ শিকার করে।
বন বিভাগের অভিযানে গত কয়েক মাসে সাতক্ষীরা রেঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ১০০ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় উদ্ধার করা হয়েছে ১৫০০টি হরিণ শিকারের ফাঁদ। ১৩টি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২০ জন চোরা শিকারিকে। এসব ফাঁদ বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, বঙ্গবন্ধুর চর, কটকা, তালপট্টি, কচিখালি, দুবলা চান্দেরশ্বর, বগি, চরখালি এলাকায়। বিভিন্ন উপলক্ষে চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায় এসব এলাকায়। শিকারিরা বনের ভেতর থেকে হরিণ শিকার করে এনে লোকালয়ে থাকা সহযোগীদের হাতে পৌঁছে দেন। বিভিন্ন জায়গায় হাতবদল হয়ে হরিণ পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
এদিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে মীরগাং টহল ফাঁড়ির বনকর্মীদের উপর হামলার চেষ্টা চালিয়েছে একদল দুবৃত্তরা। মীরগাং টহল ফাঁড়ির ওসি গোলাম কিবরিয়া জানান সোমবার সকালে তারা সুন্দরবন থেকে একটি জবাইকৃত হরিণ উদ্ধার করে। ফাঁদে আটকে পড়া হরিণটিকে জবাই করে শিকারী চক্রের সদস্যরা। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করে উদ্ধারকৃত হরিণ জমা দিতে দুপুরের দিকে তারা সাতক্ষীরা আদালতে যায়। রাত নয়টার দিকে অফিসে ফেরার পথে ১৬/১৭ জন যুবক হরিনগরের সিংহড়তলী এলাকায় তাদের উপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করে। এসময় তারা চুনকুড়ি টহল ফাঁড়ির ওসির সহায়তা নিয়ে ভিন্ন পথে পালিয়ে জীবনে রক্ষা পান। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে উপঢৌকন হিসেবে পাঠানোর জন্য ১০ কেজি হরিণের মাংসও দাবি করে চক্রের প্রধান আনিছুর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে আনিছুর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের আট নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের আহবায়ক কমিটির সদস্য। তার সঙ্গী আব্দুর রহিম, আবিয়ার ও সাহেব আলীসহ অন্যরাও যুবদলের সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িত। মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আবু জাবের মোড়লের ভাগ্নে হওয়ায় মামার প্রভাব খাটিয়ে আনিছুর হরিণ শিকার ও ঘের দখলসহ নানা ধরনের অপরাধমুলক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী রেঞ্জার হাবিবুল ইসলাম জানান চুনকুড়ি এবং মীরগাং এলাকা থেকে পরপর দু’দিনে দু’টি হরিণ উদ্ধারের কথা জানান।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, মূলত শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনের ভেতরে খাল ও নদীতে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় হরিণের বিচরণ বেড়ে যায়। যে কারণে চোরা শিকারিরা এ সময় তৎপর হয়। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু শিকারের ঘটনা ঘটলেও সেটা আগের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম। অল্প জনবল দিয়ে এত বড় বনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হয় বনবিভাগের। তিনি আরও বলেন, বন্য প্রাণী নিধন ও অন্যান্য অপরাধ দমনে বনরক্ষীরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন।
সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মশিউর রহমান বলেন, জবাইকৃত হরিণ উদ্ধারের ঘটনায় চারজনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেছেন মীরগাং টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া।