সাতক্ষীরায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট: ভূগর্ভের পানিতে আর্সেনিক দূষণের মাত্রা সর্বোচ্চ ৬১%

# মানবদেহের জন্য সহনশীল ১৫ শতাংশ আর্সেনিক
# ৭৮ শতাংশ মানুষ পাচ্ছে না নিরাপদ পানি
আবু সাইদ বিশ^াস, সাতক্ষীরাঃ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বিশ্বের সর্বাধিক আর্সেনিক দূষণ আক্রান্ত মানুষের বসবাস বাংলাদেশের এ অঞ্চলে। নিরাপদ পানি পানের সুযোগ পাচ্ছে যে খানে মাত্র ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ। খোনে পানিতে আর্সেনিক দূষণের মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করেছে । এ অঞ্চলের ভূগর্ভের পানিতে অতিমাত্রায় আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, পানিতে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ আর্সেনিক মানবদেহের জন্য সহনশীল। সেখানে জেলার টিউবওয়েল বা ভূগর্ভের পানিতে সর্বোচ্চ ৬১ শতাংশ পর্যন্ত আর্সেনিকের উপস্থিতি যা মানবদেহের জন্য ভয়ানক ক্ষতির কারণ। দেশে বর্তমানে প্রায় তিন কোটি মানুষ নিরাপদ পানি সুবিধার বাইরে। যার বেশির ভাগই বাস করে উপকূলীয় অঞ্চলে। বিভিন্ন সংস্থার একাধিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আইলাদুর্গত এলাকার ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ বর্তমানে পানযোগ্য পানিবঞ্চিত। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি এবং খুলনা জেলার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলার ১৯ ইউনিয়নে বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট। মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ মানুষ নলকূপের মাধ্যমে পানি পাচ্ছে। এখনও ৭৮ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে না। আর মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ পুকুর লোনাপানি মুক্ত। সংশ্লিষ্টরা বলছে ২০৫০ সাল নাগাদ ৯৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ৭০০ কোটি মানুষ পানির সমস্যায় পড়বেন।
২০১২ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে আর্সেনিক যুক্ত পানি পানকারীর হার ২৬ দশমিক ৬ থেকে কমে ১০ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। এরপরেও বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আর্সেনিক দূষণ আক্রান্ত মানুষের বসবাস সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায়। আর ভূগর্ভস্থ পানির অপরিকল্পিত উত্তোলনে এ সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। ফলে সুপেয় পানির উৎস সংকুচিত হচ্ছে ।

তালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দেয়া তথ্যানুযায়ী, শুধু তালা উপজেলায়ই গত তিন বছরে প্রায় দে হাজার মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়েছেন। গত দেড় বছরে মারা গেছেন আটজন। এর মধ্যে উপজেলার কৃষ্ণকাটি গ্রামে একই পরিবারের ছয়জন রয়েছেন। তালা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘এ উপজেলায়, ২০২৪ সালে ৩৯০ জন, ২০২৩ সালে ৩৭৯ জন, ২০২২ সালে ৪০৫ এবং ২০২১ সালে ৪৩৭ জন আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়েছেন। এসব রোগী বিভিন্ন সময় তালা উপজেলা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নে গত দেড় বছরে আটজন মারা গেছেন।’ তালা উপজেলায় মৃত্যু হার বেশি হলেও আর্সেনিক দূষণের মাত্রা বেশি কলারোয়ায়। সর্বোচ্চ ৬১ শতাংশ দূষণ পাওয়া গেছে সেখানকার ভূগর্ভের পানিতে।

সাতক্ষীরা জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, সাতটি উপজেলার ভূগর্ভের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ৩৪ শতাংশ, তালায় ৩৫, দেবহাটায় ৩৪, আশাশুনিতে ৪৫ এবং কালীগঞ্জে ২৮ শতাংশ। সবচেয়ে কম এবং সহনীয় মাত্রায় আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে শ্যামনগর উপজেলায়। সেখানে ভূগর্ভের পানিতে ৫ শতাংশ আর্সেনিক দূষণ রয়েছে। কলারোয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘অফিসের রেজিস্টারে ২৪ জন আর্সেনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা লিপিবদ্ধ রয়েছে। এর মধ্যে ১০ নারী ও ১৪ জন পুরুষ। এদিকে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে মানুষের চর্মরোগ থেকে শুরু করে কিডনি, দন্ত্য, চুল পড়া ও প্রস্রাবে জ্বালাপোড়াসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দিচ্ছে।

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সিনিয়র মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মানস কুমার মণ্ডল বলেন,‘আর্সেনিক মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। নিয়মিত আর্সেনিকযুক্ত পানি চর্মরোগ থেকে শুরু করে কিডনি, চুল ও দাঁত নষ্ট করে দেয়। যা ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘জেলার সব উপজেলাতেই ভূগর্ভসহ সব পানির উৎসে আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। পানি সরবরাহে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন নামে একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে।

 

Check Also

সাতক্ষীরায় মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে ছোট ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে বড় ভাই নিহত

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা সাতক্ষীরার কলারোয়ায় মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে আপন চার ভাইয়ের মধ্যে সংঘর্ষে ছোট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।