॥ আবদুল হালীম খাঁ ॥
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের জীবন ও জগৎকে নানারকম শোভা-সৌন্দর্যে ও বৈচিত্র্যে বিচিত্র রূপময় এবং কল্যাণময় করে গড়েছেন। তাঁর সৃষ্টিকর্মে মানুষের কোনো হাত নেই। তিনি তাঁর সৃষ্টি কর্মের একক কারিগর।
গ্রীষ্মের গরমের পর শান্তির বৃষ্টি বর্ষা, বর্ষার পর শান্ত-স্নিগ্ধ শরৎ, হেমন্ত, তারপর শীতকাল। শীত যেন মানুষ, পশু-পাখিসহ সব প্রকৃতিকে ঠাণ্ডায় কাঁপিয়ে তোলে। সবাই জবুথবু, নিঝুম হয়ে পড়ে। পাখির কণ্ঠ বন্ধ হয়ে যায়। সবকিছু সংকুচিত হয়ে পড়ে।
এ সময় আমরা কী চাই? মন-প্রাণ কী চায়? এ সময় মন-প্রাণ যা চায়, তাই নিয়ে হাজির হয় বসন্ত। রূপের রানি বসন্ত। চারদিক বৃক্ষে বৃক্ষে সবুজ পত্রপল্লবে নানারকম ফুল চারদিকে সুবাস ও সৌন্দর্য ছড়িয়ে অপরূপ রূপে সেজেগুজে আমাদের সম্মুখে হাজির হয় রূপের রানি বসন্ত। বসন্ত নতুন বার্তা নিয়ে আসে পৃথিবীতে। সে বার্তা ছড়িয়ে দেয় আকাশে-বাতাসে বৃক্ষের পত্রপুষ্পে, পাখির গানে, মানুষের জীবনের পরতে পরতে। জীবনে নিয়ে আসে জাগরণ। নিয়ে আসে আনন্দ। সবাই হেসে ওঠে। আহ! মরি মরি। চারদিকে বইতে থাকে আনন্দের প্লাবন।
এই যে অসীম আনন্দ আর খুশির প্লাবক কে দেন? কাকে দেন? কেন দেন? কে করেন এতসব বৈচিত্র্যে বিচিত্র রূপ-রঙের আনন্দের খেলা! তার সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক!
তিনি আমাদের মহান রব। তিনি আমাদেরকে কতই না ভালোবাসেন! তিনি অসীম দয়ালু, দাতা। তিনি আমাদের ভালোবাসেন বলেই দিয়েছেন রোজা। দিনে না খেয়ে থাকার একটু কষ্ট। মাত্র বছরে এক মাস। দিনের কিছু সময় না খেয়ে থাকায় দেহ ও মন-প্রাণে কী যে অশেষ কল্যাণ লুকিয়ে রেখেছেনÑ ঐ কিছু সময়ের ক্ষুধা-পিপাসার ভেতরে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অনুভব করা যায় মন-প্রাণ দিয়ে। এতসব কল্যাণ, আনন্দ, সুখ ও তৃপ্তি তিনি ভরে রেখেছেন এই রোজা রূপের সুগারকোটেড কুইনাইনের ভেতরে। আরো আছে।
এক মাস রমজানের রোজার পরের দিনই ঈদ। আহ! ঈদ কীযে আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে! ঈদের কথা শুনলেই আমাদের মনে-প্রাণে আনন্দ-খুশির ঝড় বইতে থাকে। সকলের মন-প্রাণ খুশিতে দোয়েলের মতো উড়তে থাকে। নতুন নতুন কাজের চিন্তায় মন ভরে যায়। নতুন কিছু পাওয়ার আনন্দে আর ঈদ উপলক্ষে প্রিয়জনদের উপহার দেয়ার আনন্দে মন শিশুদের নাচতে শুরু করে। নতুন ভালো কাপড় পাওয়ার এবং নতুন ভালো কিছু খাবার, ঘরদোর সাজাবার আনন্দে মন উপচে ওঠে।
সমাজের ধনী-গরিব, ছোট-বড় সবাই ঈদের অনেক আগেই কেনাকাটার পরিকল্পনা করতে থাকেন। পরিবারের ছোটদের আয়-ব্যয়ের বাজেট করতে হয় না। তারা মনে পাওয়া ও চাওয়ার বাজেট করতে থাকে। কার কাছ থেকে এবার কত কী পাওয়া যাবে, কত কী আদায় করা যাবেÑ সেই চিন্তায় তাদের চোখে ঘুম আসে না। আয়-ব্যয় অনুসারে বাজেট করতে হয় শুধু পরিবারের কর্তাদের।
ঈদের অনেক আগেই কেনাকাটা শুরু হয়ে যায়। শহর-গ্রামের হাট-বাজারে লোকের ভিড় পড়ে যায়। পথে-ঘাটে লোক আর গাড়ি। ছোট-বড় দোকানে ক্রেতার ভিড় পড়ে যায়। ক্রেতারা নতুন জিনিস কিনতে পেরেই খুশি আর বিক্রেতারা বেশি বেশি বিক্রি করতে পেরেই খুশি। দোকানে দোকানে যেমন ভিড়, রাস্তায় রাস্তায় গাড়ির ভিড় পড়ে যায়। কোনো কোনো সময় যাতায়াত রুদ্ধ হয়ে যায়। ঈদ কাছাকাছি এলে স্কুল-কলেজ-মাদরাসা, অফিস ও কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। চাকরিজীবীরা কাজ থেকে মুক্তি পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচে যান এবং শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে আনন্দে অধীর হয়ে পড়েন। ঘন ঘন ফোন করতে হয়, ঘন ঘন ফোন আসতে থাকে। সবাই হাসি মুখে কথা বলতে থাকেন। হাট-বাজারে, স্টেশনে, ট্রেনে-বাজে, রিকশা-ভ্যানে লোক আর লোক- যাত্রী নারী-পুরুষ-শিশু- সঙ্গে ভারী ভারী ব্যাগ। সবাই ব্যস্ত। তবু আনন্দ। সবাই খুশি। পরিচিত ও অপরিচিত সবাই যেন প্রিয় ভাই-বোন। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলাচল করেন- দাঁড়িয়ে থাকেন, হাসেন। কষ্টের মধ্যেও কীযে আনন্দ!
পরিবারে মা-বাবা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা। কতজনের কত কী প্রয়োজন। কতজনের কত যে দাবি। এ ঈদে আদায় করার সুযোগ। কারো দাবি অপূর্ণ থাকে না। আবার কেউ কেউ দাবি করে না। তবু তাকে দিতে হয় কিছু। না দিলে কেমন যেন ঠেকে। এই যে বাসার কাজের মেয়েটা। নীরবে সবার ফরমাইস করছে। ও কিছু চাচ্ছে না। আহ! বেচারির বাবা নেই। ওকে কি কিছু না দিলে চলে! ওকে একটা জামা-পায়জামা দিতে হবে। এক জোড়া জুতা না দিলে কেমন দেখায়।
পাশের বাসার ইয়াদালী ও কেরামত ভাইয়ের কী যে করুণ অবস্থা। দু’বেলা খাবারই জোটাতে পারে না। বাচ্চাদের পরণে ছেঁড়া-ময়লা একটা করে জামা। আমার ছেলেমেয়েদের চার-পাঁচটা করে আছে। তারপরও এ ঈদে কিনে দিয়েছি। আমার ছেলেমেয়েদের পোশাকের দিকে ওরা কীভাবে চেয়ে থাকে! ওদের কিছু না দিলে… ওদের কেনাকাটা করার জন্য কিছু টাকা হাতে দিলে কতই না খুশি হবে। শুধু কি রোজার ফিতরার টাকা দিলে হবে! এমনি আরো কত চিন্তা-ভাবনা। একটার পর আরেকটা। আর এসব চিন্তা মনে জাগে এ ঈদের সময়। মনটা কেমনে যেন আপনা-আপনি অপরের প্রতি, পাড়া-প্রতিবেশীদের প্রতি, অসহায়-দরিদ্রদের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। সারা বছর এমন মনে হয় না। ঈদের এটি এক জাদুকরী ক্ষমতা।
রোজার শেষ দিন। সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশের দিকে সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। হ্যাঁ, তারপর নীলকাশে কাঁচির মতো বাঁকা সাদা এক ফালি চাঁদ দেখামাত্র আনন্দে চিৎকার দিয়ে ধ্বনি দেন সবাই। চিকন বাঁকা এক ফালি চাঁদ ঈদের বার্তা ঘোষণা করে সারা মুসলিম জাহানে। ঈদের আনন্দ আরো ঘন হয়ে ওঠে ঘরে ঘরে। সারা শহর, গ্রামগঞ্জে আনন্দের ঢেউ থৈ থৈ করতে থাকে। বাবা-বাড়ির বাচ্চাদের চোখে আর ঘুম আসে না। আসে শুধু আনন্দ ও খুশির স্বপ্ন। রাত না পোহাতে সকাল হয়ে যায়।
সকালে গোসল করে শুরু হয় খাবার পালা। নানারকম খাবার আয়োজন করা হয়। তেলের পিঠা, সেমাই, ক্ষীর, পায়েস, দুধকুলি আর কত কী! প্রতিবেশীদের বাসায় বাসায় থালা ভরে দিতে হয়। তারাও আবার বিনিময় করেন। এভাবে ভাব বিনিময় হয়। গড়ে ওঠে পরম আন্তরিকতা।
খাবার পর নতুন জামা-কাপড় পরে টুপি মাথায় সেজেগুজে বাড়ির সবাই পাড়ার সবাই মিলেমিশে রওনা হয় ঈদগাহে নামাজ পড়তে। ঈদগাহ সাজানো হয় নানা রঙে। মাথার ওপর রঙিন শামিয়ানা। চারদিক রঙিন কাগজ ও কাপড়ে ঘেরা। পরিপাটি নামাজের বিছানা। আতর ও গোলাপের সুবাস ঝরতে থাকে। সারা মহল্লার ছোট-বড় সব মানুষ। সবার মুখে হাসি। আর পরস্পর ঈদ মোবারক এবং ঈদ মোবারক কোলাকুলি। সমস্যাপূর্ণ সমাজ মুহূর্তে জান্নাতের বাগানে পরিণত হয়।
এরপর সবাই মিলে জামায়াতে নামাজ।
নামাজের পর বিশ্ব মুসলিমের কল্যাণের জন্য মোনাজাত।
মোনাজাতের পর মহল্লার সকলের সঙ্গে কোলাকুলি- ভাব বিনিময়। আহ! তখন কীযে সাম্য-প্রেম-প্রীতির মধুর পরিবেশ সৃষ্টি হয়!
ঈদগাহ থেকে ফিরে এসে আবার খাবার পালা। এ সময় সবার বাসাবাড়িতে নানারকম খাদ্যের সুঘ্রাণে ভরে যায়। রান্না করা গোশত আর পোলাও-বিরানির সুঘ্রাণে জিভে পানি এসে যায়। পরিবারের সবাই মিলে একত্রে বসে খেতে সে কীযে আনন্দ। মায়ের আদর, বাবার আদর, বোনের আদর। এই আর একটু নাও। এই আর একটু… এই যে সিনার নরম হাড়টা চিবিয়ে খাও… আরে কী খেলে!
কত আদর। খেতে খেতে যে পেট ভরে যায়। একমুখে কত খাওয়া যায়।
এরপর নানি বাড়ি, খালার বাড়ি। দুই বন্ধুর বাড়ি না খেলে তো তারা রাগ করে বসবে!
আহ! এমন মজার ঈদটা যদি প্রতিদিন হতো।
এত ভালো ভালো খাবার যদি সারা বছর পাওয়া যেত।
ঈদের উপহার কী?
ঈদ আমাদের কত কী যে উপহার দেয়, তা হিসাব করে শেষ করা সম্ভব হবে না। ঈদ আমাদের মন-প্রাণ আনন্দ-খুশিতে ভরে দেয়। আমাদেরকে নতুন নতুন পোশাক-পরিচ্ছদে সাজায়। ঘরদোর নতুনরূপে সাজায়। আমাদের সারা বছরের দুঃখ-কষ্ট ও শ্রমে ক্লান্ত শরীরের বেদনা ক্লান্তি মুছে দেয়। শরীরে ও কর্মে নতুন উৎসাহ ও প্রেরণা দান করে। মনের হিংসা, ঘৃণা, ভেদাভেদ দূর করে দেয়। সমাজের দরিদ্র, দুর্বল ও অসহায় মানুষের প্রতি সমবেদনা ও মানবতাবোধ জাগিয়ে তোলে। সমাজের সকল মানুষকে ভালোবাসা, প্রেম-প্রীতি-সাম্য-সমতা ও ঐক্যের একতা বন্ধনে আবদ্ধ করে। দেশ এবং জাতিকে করে শক্তিশালী। নব নব চিন্তা ও কর্মে সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। ঈদ ব্যতীত অন্য কোনো উৎসব সমাজের মানুষকে এমন গভীরভাবে প্রভাবিত করে না।
তাই বলতে ইচ্ছে করে-
আহ! ঈদ যদি বারো মাসে হতো বার বার,
পৃথিবীতে থাকত না ভেদাভেদ হাহাকার।
