ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক দেশ গড়ার উপযোগী জনশক্তি তৈরির কাজ করছে ছাত্রশিবির

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক দেশ গড়ার উপযোগী জনশক্তি তৈরির কাজ করছে ইসলামী ছাত্রশিবির। আমাদের এ বছরের স্লোগান- ‘মেধা ও সততায় গড়বো সবার বাংলাদেশ’। এমন একটি বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকার, যেখানে ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য থাকবে সমান সুযোগ, ন্যায়বিচার এবং মর্যাদা। আমার বিশ্বাস, ৩৬ জুলাই-পরবর্তী এ নতুন বাস্তবতা জাতির সামনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রকৃত রূপ তুলে ধরতে সাহায্য করছে। এ পরিবেশ আমাদের আরও বৃহৎ পরিসরে ছাত্রশিবিরকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি, সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। মূলত পরিবর্তন এসেছে পরিবেশ, সুযোগ এবং সবার দৃষ্টিভঙ্গিতেও।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হারুন ইবনে শাহাদাত
সোনার বাংলা: দেশবাসী ২০২৪-এর ৩৬ জুলাই বিপ্লবের পর এক নতুন ইসলামী ছাত্রশিবির দেখছে। আপনারও কি তাই মনে হয়?
জাহিদুল ইসলাম: অনেকের কাছে হয়তো এমনটা মনে হতে পারে যে, ৩৬ জুলাইয়ের পর ইসলামী ছাত্রশিবির নতুনভাবে আবির্ভূত হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত বিষয় হলো ইসলামী ছাত্রশিবির সেই ১৯৭৭ সালেই যে আদর্শ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, আজও সেই একই লক্ষ্যে অবিচলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা সেদিনও বলেছি, আজও বলছি- চমক লাগানো সাময়িক কোনো উদ্দেশ্য হাসিল আমাদের লক্ষ্য নয়। বরং আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চিরন্তন ও স্থায়ী। আমরা আল্লাহর এ জমিনে সকল প্রকার জুলুম-নির্যাতনের মূলোচ্ছেদ করে ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়ের সৌধের ওপর একটি আদর্শ ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চাই। আমরা মনে করি, আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন আদর্শ নাগরিক ও নেতৃত্বের। এ লক্ষ্যেই ছাত্রশিবির সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরির ভিশন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
গত ১৬ বছর জাতির ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে থাকা খুনি হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের বর্বর দমন-পীড়নের মধ্যেও ছাত্রশিবির তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে। রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, গুম-খুন, শাহাদাত, হামলা-মামলা- এ বাস্তবতা ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। এতসব নিপীড়নেও আমরা দমে যাইনি। তবে হ্যাঁ, তখনকার রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডা ও নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার কারণে আমাদের কার্যক্রমসমূহ ছাত্র-জনতার নিকট প্রচার হয়নি। বরং আমাদের বিরুদ্ধে ছিল পরিকল্পিত অপপ্রচার ও অপবাদ। ইসলামী ছাত্রশিবির যে শিক্ষাবান্ধব, নৈতিকতাভিত্তিক ও মানবসেবামূলক কাজ করে, তা মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়নি; বরং বিকৃতরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। শত প্রতিবন্ধকতা থাকলেও আমরা বরাবরই কর্মপদ্ধতির আলোকে আমাদের কাজসমূহ চালিয়ে গেছি। দিন দিন আমাদের সংগঠন অব্যাহতভাবে সম্প্রসারিতও হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।
২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই বিপ্লবের পর দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ আওয়ামী ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়েছে। আমরা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আমাদের কার্যক্রমসমূহ শিক্ষার্থীদের নিকট উপস্থাপন করার সুযোগ পাচ্ছি। এ নতুন বাস্তবতায় ইসলামী ছাত্রশিবিরের আদর্শিক কর্মকাণ্ডের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়েছে। তবে এটি কোনো হঠাৎ পরিবর্তন নয়, বরং একটি দীর্ঘস্থায়ী ও ধারাবাহিক আদর্শচর্চার স্বাভাবিক পরিণতি। আমরা শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্বকে বোঝার চেষ্টা করছি। আমাদের লক্ষ্য ও ভিশন অর্জনে সময় ও পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এ বছর ৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমরা প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছি- ‘মেধা ও সততায় গড়বো সবার বাংলাদেশ’। অর্থাৎ এমন একটি বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকার, যেখানে ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য থাকবে সমান সুযোগ, ন্যায়বিচার এবং মর্যাদা।
আমার বিশ্বাস, ৩৬ জুলাই-পরবর্তী এ নতুন বাস্তবতা জাতির সামনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রকৃত রূপ তুলে ধরতে সাহায্য করছে। এ পরিবেশ আমাদের আরও বৃহৎ পরিসরে ছাত্রশিবিরকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি, সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। মূলত পরিবর্তন এসেছে পরিবেশ, সুযোগ এবং সবার দৃষ্টিভঙ্গিতেও।
সোনার বাংলা: কীভাবে ইসলামী ছাত্রশিবির এ অসম্ভবকে সম্ভব করলো। সংক্ষেপে যদি বলতেন।
জাহিদুল ইসলাম: যুগে যুগে সব ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী শক্তি নিজেদের অপরাজেয় মনে করে এসেছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারও সেই ভাবনাতেই আচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সকল স্বৈরাচারেরই একটি পর্যায়ে এসে পতন ঘটে। আল্লাহর রহমতে দীর্ঘ ১৬ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম, ত্যাগ ও প্রতিরোধ শেষে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তারা পতিত হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ। এটি শুধু কোনো একটি সংগঠনের নয়, বরং গোটা ছাত্রসমাজ ও সচেতন জনগণের মিলিত সাহসিকতা ও অবিচলতার ফল।
আমরা দেখেছি, বিগত সরকার ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ দেশপ্রেমিক ছাত্রসমাজের ওপর কতটা দমন-পীড়ন চালিয়েছে। আমাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল, কর্মসূচিতে হামলা চালানো হতো, হাজারো মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, গুম আর নির্যাতন ছিল আমাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা। এমন একসময় ছিল, যখন অনেকে ভাবতেন, আর কোনোদিন হয়তো এ স্বৈরতন্ত্রের অবসান হবে না, গণজাগরণ আর সম্ভব নয়। তবে আমরা সবসময় এ অব্যাহত জুলুম-পীড়নের প্রতিবাদ করে গেছি। ছাত্রসংগঠন হিসেবে শিক্ষার্থীদের ন্যায়সঙ্গত সকল আন্দোলনেও আমরা অংশ নিয়েছি। সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনেও আমরা যুক্ত ছিলাম। কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারের পেটোয়া বাহিনীর অত্যাচার ও গণহত্যা আমাদের ব্যথিত ও আহত করেছে। ইন্টারনেট শাটডাউনের সময় একটা পর্যায়ে আন্দোলনের ফেস সমন্বয়করা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এ সময় আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রশিবির একেবারে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় এবং আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ধরে রাখে। অবশেষে আস্থা, ঐক্য আর ত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে জুলাই আন্দোলন আল্লাহর রহমতে মনজিলে মকসুদে পৌঁছাতে পেরেছে, আলহামদুলিল্লাহ।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের ২৩৪ জন ভাই শহীদ হয়েছেন, এখনো ৭ জন ভাই নিখোঁজ। জুলাই আন্দোলনে আমাদের অসংখ্য ভাই শাহাদাতবরণ করেছেন। অনেক ভাই জীবনবাজি রেখে রক্ত দিয়েছেন, অনেকে আহত হয়ে আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। তারা কেউই ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নয়- দেশ, ইসলাম ও অধিকার রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। এ ত্যাগই আমাদের বিজয়ের মূল শক্তি।
আমার ভাইয়েরা, আমার বোনেরা রক্ত দিয়ে এ বিপ্লবকে সফল করেছে। যারা প্রতিরোধ করেছে নিরস্ত্র হয়ে, যারা রাতের পর রাত ছদ্মবেশে থেকে সংগঠনকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যারা বছরের পর বছর কারাগারে থেকেও মনের ভেতর বিশ্বাস হারায়নি- তাদের জন্যই আজ আমরা স্বাধীন বাতাসে নিশ্বাস নিচ্ছি। এটি একদিনের অর্জন নয়; এটি ধৈর্য, সাহসিকতা এবং বহু বছর ধরে সংঘটিত প্রচেষ্টার ফসল।
আমরা কখনো হতাশ হইনি, কখনো পিছু হটিনি। আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবিচল থেকে আমরা লড়াই চালিয়ে গেছি। আমি মনে করি, এ কৃতিত্ব গোটা ছাত্রসমাজের। মতপার্থক্য ভুলে দেশের ছাত্রসমাজ যখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তখন কোনো দমন-পীড়ন, কোনো কুৎসা, কোনো নির্যাতন তাদের পথ রুদ্ধ করতে পারেনি। অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্য যা দরকার- সেটা ছিল আপসহীন মনোবল, নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন, আর অদম্য সাহস। ইসলামী ছাত্রশিবির ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক ছাত্রসংগঠনগুলো সেটাই দেখিয়েছে।
৩৬ জুলাইয়ের বিজয় একক কারো নয়, এ বিজয় শহীদদের, আহতদের, নিখোঁজ ভাইদের, নির্যাতিত পরিবারগুলোর এবং সেসব ছাত্র-জনতার, যারা নির্ভীকভাবে ন্যায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং আমি বলবো, আজকের এই ‘নতুন বাংলাদেশ’-এটা আমাদের সবার সম্মিলিত ত্যাগের ফসল, যা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
সোনার বাংলা: কবে, কীভাবে ছাত্রশিবিরে যোগ দিয়েছেন? এত ছাত্রসংগঠন থাকতে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে কেন বেছে নিলেন?
জাহিদুল ইসলাম: আমি ছোটবেলা থেকেই কিশোর কণ্ঠের নিয়মিত পাঠক ছিলাম। যে ভাইয়েরা আমাকে ম্যাগাজিনটি পৌঁছাতেন, তাঁরা সবসময় আমাকে পড়াশোনা ও ভালো কাজের জন্য উৎসাহ দিতেন। আমার ছাত্রশিবিরে আসার পেছনে তাদের ব্যক্তিত্বের প্রতি মুগ্ধতাই হচ্ছে মুখ্য।
আমার ছাত্রজীবনের শুরু থেকেই আমি একটি আদর্শবাদী, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও শিক্ষার্থীবান্ধব সংগঠনের সন্ধানে ছিলাম- যেখানে ব্যক্তি গঠনের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ থাকবে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের দর্শন ও কার্যক্রম আমাকে শুরু থেকেই গভীরভাবে আকর্ষণ করেছে। আমি দেখেছি, দেশের অনেক ছাত্রসংগঠনে রাজনীতি মানেই ক্ষমতার লড়াই, মারামারি কিংবা একে অপরকে দমন করার প্রতিযোগিতা। কিন্তু ইসলামী ছাত্রশিবির এ ধারা থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এটি ‘গতানুগতিক সংগঠন নয়’, বরং এটি শিক্ষার্থীদের আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষে বিশ্বাসী একটি ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষাপ্রতষ্ঠান।
প্রথমেই বলবো, ছাত্রশিবিরের ইসলামী আদর্শ, নৈতিক মূল্যবোধ এবং চারিত্রিক উৎকর্ষে জোর দেওয়ার বিষয়টি আমার নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে একীভূত হয়েছে। এখানে কেবল প্রচলিত ধারার কথিত রাজনীতি নয়, বরং ব্যক্তি গঠন, আত্মশুদ্ধি এবং নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমি বিশ্বাস করি, একটি জাতি গঠনের পূর্বশর্তই হলো আদর্শবান ও দক্ষ নাগরিক তৈরির প্ল্যাটফর্ম- ছাত্রশিবির ঠিক সেই কাজটাই করে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, ছাত্রশিবির শিক্ষার্থীদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এটি এমন একটি সংগঠন, যা কখনোই ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মতের বাইরে কোনো মতবাদ চাপিয়ে দেয় না, বরং সাধারণ শিক্ষার্থীরা যা প্রত্যাশা করে, শিবির সেই অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ শিক্ষার্থীবান্ধব মনোভাবকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখেছি।
আরেকটি বিষয়, যেটি আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে- ছাত্রশিবিরের শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশ। এখানে সিনিয়র-জুনিয়রের মাঝে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, আন্তরিকতা ও সহযোগিতার এক অনন্য বন্ধন বিদ্যমান। এটি একটি পরিবারভিত্তিক কাঠামো, যেখানে প্রতিটি সদস্যের উন্নয়ন ও কল্যাণে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকে। বিপরীতে অন্য অনেক সংগঠনে গ্রুপিং, কোন্দল, দ্বন্দ্ব এবং নেতৃত্ব নিয়ে মারাত্মক বিভাজন দেখেছি, যা একজন ছাত্র হিসেবে আমার কাছে হতাশাজনক লেগেছে।
মূলত ইসলামী ছাত্রশিবির শুধুই রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরির কথা বলে না; বরং জাতিকে আলোকিত করতে আদর্শ নাগরিক তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়। জ্ঞানে, গুণে ও নীতিতে পরিপূর্ণ মানুষ তৈরিই এর প্রকৃত লক্ষ্য। আমার কাছে এ প্ল্যাটফর্মটি আত্মোন্নয়ন, দক্ষতা অর্জন এবং দেশ-জাতির সেবায় নিজেকে প্রস্তুত করার এক অনন্য ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেছে। তাই দেশের অন্যান্য বহু সংগঠন থাকতে ইসলামী ছাত্রশিবিরকেই আমি বেছে নিয়েছি, এটি ছিল আমার জন্য খুব স্বাভাবিক, সুস্পষ্ট এবং আত্মবিশ্বাসী একটি সিদ্ধান্ত।
সোনার বাংলা: প্রচলিত ধারার ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
জাহিদুল ইসলাম: দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, প্রচলিত ধারার ছাত্র রাজনীতির মূল্যায়ন করতে গেলে হতাশ না হয়ে উপায় নেই। কিছু কিছু ছাত্রসংগঠন আদর্শচর্চা ও সেবার মানসিকতা থেকে সরে গিয়ে একপ্রকার শোষণ ও বলয় তৈরির অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। রাজনীতিকে জনসেবা হিসেবে নয়, বরং সুবিধা ও দখলের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখেছে তারা। ফলে আমরা শিক্ষাঙ্গনে প্রায় প্রতিনিয়তই দেখতে পেয়েছি হামলা, হত্যাকাণ্ড, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, সেশনজট, মাদকাসক্তি ও বিশৃঙ্খলার ভয়াবহ চিত্র। এগুলো এখন সাধারণ ছাত্রদের কাছে ‘ছাত্র রাজনীতি’ শব্দটিকেই আতঙ্কের প্রতীক বানিয়ে দিয়েছে।
বিশেষ করে বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলে যারা ক্ষমতার ছত্রছায়ায় ছিল, তাদের ছাত্রসংগঠনগুলো গোটা ক্যাম্পাসকে একপ্রকার সন্ত্রাসের রাজ্যে পরিণত করেছিল। সাধারণ ছাত্রদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করা তো দূরের কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ে কুরআন তেলাওয়াত প্রোগ্রাম করতেও তাদের রক্ত দিতে হয়েছে। এমন এক ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থী মাত্রই রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়েছিল, যেটা জাতির জন্য ভয়ংকর বিপর্যয়। যে ছাত্র রাজনীতির কারণে মায়ের বুক খালি হয়, শিক্ষার্থী পঙ্গু হয়, লাশ গুনতে হয়, সেই রাজনীতি আমরা চাই না, দেশের জনগণও তা চায় না।
সংগঠন হিসেবে ছাত্রশিবির নিজেই এসব অপরাজনীতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। আমাদের অসংখ্য নেতা-কর্মী অতীতে হত্যা, খুন, গুম, গ্রেফতার ও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বুয়েটে আবরার ফাহাদ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডসহ এমন অসংখ্য ঘটনা ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করেছে। আমাদের অনেক ভাই শুধুমাত্র ছাত্রশিবির করার কারণে তাদের একাডেমিক জীবন শেষ করতে পারেনি। আমরা কোনো দিন চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলদারিত্বের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করিনি, তাই হয়তো আমাদের সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হতে হয়েছে।
আমি আজ স্পষ্ট করে বলতে চাই, ৩৬ জুলাইয়ের বিপ্লবের পর বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির এ কলঙ্কিত চেহারাটা আর চলতে পারে না। রাজনীতি হতে হবে আদর্শিক নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা, জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা। অস্ত্রের মহড়া, চাঁদাবাজি, হল দখল নয়- আমরা চাই যুক্তি ও নীতির ভিত্তিতে মতপ্রকাশের সুযোগ থাকুক, সহাবস্থানের পরিবেশ গড়ে উঠুক।
বিশেষ করে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ অতীতে ছাত্র রাজনীতিকে কলঙ্কিত করেছে, তারাই আসলে ছাত্রসমাজকে রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে। এ সংস্কৃতি এখন বদলাতে হবে। আমি এমন একটি ছাত্র রাজনীতি চাই, যেখানে ভিন্নমত থাকবে, কিন্তু তা থাকবে গঠনমূলক বিতর্ক ও আদর্শভিত্তিক প্রতিযোগিতায়। যেখানে নেতা মানে হবে সেবক। প্রচলিত অনেক সংগঠন এ মানদণ্ডে ব্যর্থ হয়েছে- এটাই নির্মম বাস্তবতা।
আমাদের এখন দায়িত্ব, এই ভেঙে পড়া আস্থার জায়গাটিকে ফিরিয়ে আনা। ছাত্র রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে তার প্রকৃত উদ্দেশ্যে- নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ, দেশপ্রেমিক ও মেধাবী প্রজন্ম গড়ার কাজে। ইসলামী ছাত্রশিবির সেই ধারারই প্রতিনিধিত্ব করে। আমরা অতীতে যেমন আদর্শচর্চার পক্ষে ছিলাম, ভবিষ্যতেও শিক্ষাঙ্গনে জ্ঞান, নৈতিকতা ও ন্যায়ের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য আপসহীন থাকবো, ইনশাআল্লাহ। আমরা দীর্ঘদিনের অচলায়তন ভেঙে একটি সুস্থধারার ছাত্র রাজনীতি চর্চার পরিবেশ তৈরি জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
সোনার বাংলা: ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা অনেকে বলছেন। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
জাহিদুল ইসলাম: আমি মনে করি, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা কোনো সমাধান নয়। বরং শিক্ষাঙ্গনে যে ছাত্র রাজনীতি মানুষের প্রাণ নেয়, মায়ের বুক খালি করে, সেই রাজনীতিরই অবসান হওয়া উচিত। ছাত্র রাজনীতি মানে যদি খুনোখুনি, সন্ত্রাস আর সেশনজট হয়, তা কেউ চাইবে কেন? আমরাও চাই না। এটি আসলে ছাত্র রাজনীতি নয়, বরং অপরাজনীতি।
কিন্তু তাই বলে ছাত্র রাজনীতিই বন্ধ করে দিলে, ইতিবাচক নেতৃত্ব বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। ইতিহাস সাক্ষী, দেশের সংকটে ছাত্রসমাজই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। ভাষা আন্দোলন হোক, স্বাধীনতা যুদ্ধ হোক কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম সব ক্ষেত্রেই ছাত্ররা ছিল অগ্রণী। সদ্যসমাপ্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী গণআন্দোলনেও ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। এখন যদি ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়, ভবিষ্যতের সেই নেতৃত্ব কোথা থেকে আসবে?
বরং আমাদের দরকার ছাত্র রাজনীতিকে তার সুষ্ঠুধারায় ফিরিয়ে আনা। ছাত্র রাজনীতি বলতে আমরা বুঝি এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে জ্ঞানচর্চা থাকবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, নেতৃত্ব গঠনের সুযোগ থাকবে, সেবার প্রতিযোগিতা থাকবে এবং গঠনমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। এই ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা চাই, শিক্ষাঙ্গনে যে রাজনীতি হবে, তা হবে মেধাভিত্তিক, নৈতিকতাভিত্তিক এবং গণতান্ত্রিক চর্চায় পরিপূর্ণ।
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়, অপরাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। যারা ক্যাম্পাসে সহিংসতা চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, কিন্তু যারা শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে, তাদের সুযোগ দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বের অধিকার অস্বীকার করে গণতন্ত্র সম্ভব নয়। আমরা চাই সুস্থ, ইতিবাচক ও শিক্ষাবান্ধব ছাত্র রাজনীতি- যেটা দেশের ভবিষ্যৎ গড়তে পারে।
সোনার বাংলা: সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে শিবির কেন অংশ নেয়নি, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আপনাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করবেন কি?
জাহিদুল ইসলাম: ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনটি হয়েছিল এমন একসময়, যখন ক্যাম্পাসে কার্যত একদলীয় দখলদারিত্ব চলছিল। ইসলামী ছাত্রশিবিরের জন্য তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার ন্যূনতম সুযোগই ছিল না ৯০-এর দশক থেকে। শত শত নেতা-কর্মী শহীদ, অনেকে পঙ্গু, হাজারো ভাই কারাবন্দি, ৭ জন ভাই নিখোঁজ- এ বাস্তবতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা তো দূরের কথা, মনোনয়ন দেওয়াও অসম্ভব ছিল। উপরন্তু, সে সময়ের ডাকসু নির্বাচন ছিল একরকম প্রহসন, যেখানে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল- কে জিতবে আর কে হারবে। সে কারণেই আমরা প্রক্রিয়া থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলাম।
কিন্তু এখন সময় বদলেছে। বিপ্লবের পর ক্যাম্পাসে ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ ফিরতে শুরু করেছে। তাই আমরা মনে করি, এখন একটি সত্যিকারের, প্রতিনিধিত্বমূলক ছাত্রসংসদ নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে, আমরাও প্রস্তুত। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছিলাম তারাসহ অন্যান্য সংগঠনগুলোও ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে। আমরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবিলম্বে ছাত্রসংসদ নির্বাচন চাচ্ছি।
আমরা বিশ্বাস করি, নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সরাসরি প্রশাসনের কাছে নিজেদের দাবি তুলে ধরতে পারে। এখনকার বাস্তবতায় কোনো ছাত্রসংগঠন দাবি নিতেও গেলে আগে ভাবতে হয়, মূল দলের অবস্থান কী। এতে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনগুলো রাজনীতির ক্যালকুলেশনে চাপা পড়ে যায়। কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধি হলে তারা সরাসরি শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলবে- দলের পক্ষে নয়। দেরি না করে এখনই নির্বাচন হওয়া উচিত- গণআন্দোলনের অর্জন ধরে রাখতে হলে এটাই সময়।
সোনার বাংলা: দেশের সংবাদমাধ্যম; বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়ার ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাচ্ছি?
জাহিদুল ইসলাম: বাংলাদেশের গণমাধ্যম গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়া জনমত গঠন ও তথ্যপ্রবাহে বড় ভূমিকা রাখে। আমি মনে করি, নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েও আমাদের প্রিন্ট মিডিয়া এক ধরনের পরিপক্বতা অর্জন করেছে। তবে এটি সত্য যে, গত দেড় দশকে দেশে ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে গণমাধ্যম অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত ছিল। বহু তথাকথিত মূলধারার মিডিয়া স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি; সরকারি হস্তক্ষেপ ও চাপে নতি স্বীকার করেছে। এমনকি কিছু সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী সরাসরি সরকারের ভাষায় কথা বলেছেন, বিরোধী আন্দোলনকে খাটো করে দেখেছেন। গণতন্ত্রের নামে চলেছে স্বৈরাচার, আর অনেক টকশো ও সম্পাদকীয়তে তা যেন স্বাভাবিক বলেই মেনে নেওয়া হয়েছে- এটা অত্যন্ত হতাশাজনক।
তবে এটাও সত্য, সব মিডিয়া একইরকম ছিল না। অনেক সাংবাদিক ও সংবাদপত্র ছিলো যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্য প্রকাশের চেষ্টা করেছেন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। আমি তাঁদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই। বিশেষ করে সাপ্তাহিক সোনার বাংলাসহ যেসব প্রিন্ট মিডিয়া ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি কিংবা শিক্ষাঙ্গনের সংকটগুলো সাহসের সঙ্গে তুলে ধরেছে, তারা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়াও রেখেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা।
বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাবে মিডিয়া স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। আমি আশা করি, এখন থেকে পত্রিকাগুলো সত্যিকার অর্থেই নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশন করবে। গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো বিশ্বাসযোগ্যতা যার মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হয়। আমি চাই, মিডিয়া কোনো দলের মুখপাত্র না হয়ে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হোক। শিক্ষার্থীদের অধিকার, শিক্ষাঙ্গনের বাস্তবতা, দেশের ভবিষ্যৎ- এসব নিয়ে তারা বস্তুনিষ্ঠভাবে কথা বলুক।
গণমাধ্যমের সমালোচনার পাশাপাশি আমি তাদের ভূমিকার প্রতি আস্থাও প্রকাশ করতে চাই। কারও চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে অন্যায়-অবিচার তুলে ধরা, গঠনমূলক সমালোচনা করা এবং ভালো কাজের প্রশংসা করাই হোক তাদের দায়িত্ব। আমি সাংবাদিক সমাজকে বলবো, এখন আপনারা ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। স্বাধীনতার এ নবজাগরণে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবিচল থাকুন। ইসলামী ছাত্রশিবির সবসময়ই দায়িত্বশীল ও মুক্ত সাংবাদিকতার পক্ষে ছিল এবং থাকবে। আমরা বিশ্বাস করি, সত্যনিষ্ঠ গণমাধ্যম কোনো স্বৈরশাসককে দীর্ঘস্থায়ী হতে দেয় না। গণতন্ত্র রক্ষায়, শিক্ষার অগ্রগতিতে এবং জাতি গঠনে গণমাধ্যম আমাদের শক্তিশালী মিত্র- আমরা সেই দৃষ্টিভঙ্গিতেই তাদের দেখি।
সোনার বাংলা: সংস্কার প্রশ্নে সমমনা ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠছে না কেন?
জাহিদুল ইসলাম: এটা সত্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আমরা সবাই একসঙ্গে লড়েছি। কিন্তু শত্রুর পতনের পর পরবর্তী ধাপে এসে কিছু মতপার্থক্য সামনে চলে এসেছে। বিভিন্ন সমমনা ছাত্রসংগঠনের মধ্যে কৌশলগত অবস্থানগত ভিন্নতা তৈরি হয়েছে- কেউ আগে রাজনৈতিক সংস্কার চায়, কেউবা সরাসরি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চায়। যেমন, ছাত্রদলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সংস্কার হোক এরপর ছাত্রসংসদ নির্বাচন হোক। আবার জাতীয় নির্বাচনের প্রশ্নে উনারা আগে নির্বাচন পরে সংস্কার এমনটা মতামত দেন। এটা অনেকটা দ্বৈত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। ‘সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে’- এ বিতর্কই আপাতত সবাইকে এক মঞ্চে আনতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, এটা একটি সাময়িক বিভ্রান্তি। আমাদের বৃহত্তর লক্ষ্য কিন্তু অভিন্ন- গণতন্ত্র রক্ষা এবং শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা। তবে আমি এটাও বলবো, ঐক্য গড়ে না ওঠার পেছনে দুটি বিষয় স্পষ্টভাবে দায়ী- এক. পারস্পরিক আস্থার ঘাটতি, দীর্ঘদিনের দূরত্ব এখনো কাটেনি। দুই. ২০২৪-এর বিপ্লবের কৃতিত্ব নিয়ে কে কী পেল বা পায়নি, এই মনোভাব থেকে ক্ষমতার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার মানসিকতা। যেখানে বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ছিল দেশ গড়া, সেখানে কিছু সংগঠন সেই জায়গা থেকে সরে গিয়ে ‘ক্রেডিট ভাগাভাগি’ ও অবস্থান নির্ধারণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক।
তারপরও আমি আশাবাদী। আমি নিজ থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেছি, আমরা যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে একসঙ্গে ছিলাম, আমাদের ভবিষ্যতেও ঐক্যবদ্ধভাবে এ দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। আদর্শে পার্থক্য থাকতেই পারে, মতের ভিন্নতা থাকবে, কিন্তু এ বাংলাদেশটা আমাদের সবার- ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, সকল ইসলামী সংগঠন, বাম, ডান, সবাই মিলেই আমরা দেশের ভবিষ্যৎ। মৌলিক লক্ষ্য এক, দেশের উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত করা।
তাই বলবো, পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে হবে। কেউ যেন কারো অবস্থান নিয়ে সন্দেহ না করে, কৌশলগত মতভেদকে যেন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হিসেবে না দেখে। ইতোমধ্যেই আমরা একে অপরের অনুষ্ঠানে যাচ্ছি, সংলাপ হচ্ছে- এটা ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। ছাত্রশিবির সবসময় ঐক্যের পক্ষেই ছিল এবং থাকবে। আমি আশাবাদী, খুব শিগগির আমরা আমাদের লক্ষ্যগুলোয় ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবো।
সোনার বাংলা: দেশের ছাত্র রাজনীতির ব্যাপারে বহুদিনের অভিযোগ যে, তারা ছাত্রদের জন্য নয়, জাতীয় দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি হিসেবে রাজনীতি করে। এ অভিযোগের উত্তরে ছাত্রশিবিরের অবস্থান কী?
জাহিদুল ইসলাম: অভিযোগটির ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। সত্যিই আমাদের দেশে অনেক ছাত্রসংগঠন মূলধারার রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার জন্য লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ও হচ্ছে। ফলে ছাত্রদের নিজস্ব সমস্যা, স্বার্থ ও দাবি প্রান্তিক ব্যাপার হয়ে পড়েছে। আমি নিজেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখেছি- অনেক সংগঠনের নেতাকর্মী ছাত্রদের বদলে বড় নেতাদের খুশি করতে ব্যস্ত, ছাত্রদের সঙ্গে তাদের সংযোগ ছিল না বললেই চলে। এর ফলে ছাত্র রাজনীতি কলুষিত হয়েছে, আর ছাত্রসমাজ হয়েছে বঞ্চিত।
ইসলামী ছাত্রশিবির শুরু থেকেই এ ধারা থেকে নিজেকে পৃথক রেখেছে। আমাদের আদর্শিক উৎস পবিত্র কুরআন ও আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর অনুসৃত পথ সুন্নত থেকে। আমাদের সকল কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মেধাবিকাশ, নৈতিক উৎকর্ষ ও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়- এটা কেবল কথার কথা নয়, আমাদের বাস্তব কর্মসূচিতে তা প্রতিফলিত হয়।
ছাত্রশিবির কখনোই অন্ধভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের নির্দেশে চলে না, ভবিষ্যতেও চলবে না। আমরা যারা ক্যাম্পাসে রাজনীতি করি, আমাদের সবচেয়ে বড় দায়বদ্ধতা সাধারণ ছাত্রদের প্রতি। এখনো যদি কোনো শিক্ষার্থী ন্যায্য দাবি নিয়ে আসে, আমরা কখনো জিজ্ঞেস করি না তার রাজনৈতিক পরিচয় কী। আমরা তার পাশে দাঁড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।
এ ‘দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি’ থেকে বের হওয়ার স্থায়ী পথ হল নির্বাচিত, স্বতন্ত্র ছাত্র-প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আমি আগেও বলেছি, বর্তমানে অনেক ছাত্রসংগঠন প্রশাসনের কাছে কোনো দাবি জানাতে গেলে তাদের আগে ভাবতে হয় ‘মূল দলের অবস্থান কী’। এ সংস্কৃতি বদলাতে হবে। আমরা চাই, ছাত্রনেতারা ছাত্রদের পক্ষে কথা বলুক, কোনো রাজনৈতিক দলের স্বার্থে নয়।
যদি ডাকসু বা ছাত্রসংসদের মতো গণতান্ত্রিক নির্বাচনগুলো নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রতিটি ক্যাম্পাসে প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে লেজুড়বৃত্তির প্রবণতা আপনা-আপনি কমে আসবে। তখন মূল আলোচনায় থাকবে ছাত্রদের ইস্যু, দলের নয়। ছাত্রশিবির এ ব্যবস্থাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে। আমাদের সাংগঠনিক নীতিতেই শেখানো হয়, রাজনীতি মানে ছাত্রদের অধিকার আদায়, সেবা ও নেতৃত্ব বিকাশের প্ল্যাটফর্ম; কোনো দলের এজেন্ট হয়ে কাজ করার জায়গা নয়।
আমাদের রাজনীতি সাধারণ ছাত্রদের জন্য, তাদের অধিকার, কল্যাণ এবং নেতৃত্ব বিকাশে সহায়তা করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। কেউ যদি মনে করেন ছাত্রশিবির কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি করে, আমি বলবো- আমরা আসলে আগামী দিনের পূর্ণাঙ্গ নেতৃত্ব তৈরি করছি- যারা হবেন শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, প্রশাসক, একজন দক্ষ নাগরিক এবং ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জীবিত দেশসেবক- এটাই ছাত্রশিবিরের স্বাতন্ত্র্য।
সোনার বাংলা: ছাত্রশিবির কি শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বই তৈরি করছে? নাকি জাতির কল্যাণে এর বাইরেও কোনো কর্মসূচি আছে?
জাহিদুল ইসলাম: অবশ্যই, ছাত্রশিবিরের কর্মকাণ্ড শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরিতে সীমাবদ্ধ নয়। বরং রাজনৈতিক পরিসরের বাইরের দিকটিই আমাদের পরিচয়ের মূল ভিত্তি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইসলামী ছাত্রশিবির দুটি লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছে- একদিকে আদর্শিক নেতৃত্ব সৃষ্টি; অন্যদিকে জাতির সার্বিক কল্যাণে অব্যাহত প্রয়াস।
প্রথমেই বলি, শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকার কথা। ছাত্রশিবির ক্যাম্পাসে পড়াশোনার পরিবেশ উন্নয়নে এবং মেধাবীদের উৎসাহিত করতে নিয়মিত প্রকাশনা উৎসব, বইমেলা, বিজ্ঞানমেলা, বিতর্ক ও কুইজ প্রতিযোগিতার মতো অনুষ্ঠান আয়োজন করে। সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে ‘ইবনে আল-হাইসাম সায়েন্স ফেস্ট ২০২৪’ কিংবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘নববর্ষ প্রকাশনা উৎসব ২০২৫’-এ শিক্ষার্থীদের বিপুল সাড়া আমাদের এ প্রচেষ্টারই স্বীকৃতি। আমাদের রয়েছে বইসহ ছোট-বড় পাঁচ শতাধিক নিজস্ব প্রকাশনা। বিজ্ঞানভিত্তিক ও গবেষণাধর্মী এসব প্রকাশনা নিয়মিত হালনাগাদ করা হয়। সারা দেশের শিক্ষার্থী ও পাঠক মাত্রই এগুলোর মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, আমরা জাতির মানবসম্পদ উন্নয়নে কাজ করছি। নেতা মানে কেবল রাজনৈতিক নেতা নয়, যে যেই পেশাতেই থাকুক, যদি সে সৎ, দক্ষ ও মানবিক হয়, তবে সে-ই জাতির সম্পদ। ছাত্রশিবির আজ দক্ষ, যোগ্য ও চারিত্রিক গুণসম্পন্ন মানুষ গড়ার এক অবিচল যাত্রায় নিয়োজিত। আমাদের প্রশিক্ষণ, সেমিনার, কর্মশালায় নৈতিকতা ও ব্যষ্টিক নেতৃত্বের বিকাশে জোর দেওয়া হয়। এরই ফলে শিবিরের বহু সাবেক কর্মী আজ দেশ-বিদেশে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, অধ্যাপকসহ বিভিন্ন পেশায় কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করছেন এবং তাঁদের মধ্যে শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধ স্পষ্ট প্রতিফলিত হচ্ছে।
তৃতীয়ত, ছাত্রশিবিরের মানবসেবামূলক কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরেই প্রশংসনীয়। দুর্যোগ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় কিংবা করোনা যেখানেই মানবিক বিপর্যয়, শিবিরের কর্মীরা সর্বদা সক্রিয় থেকেছে। আমরা শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, স্বেচ্ছায় রক্তদান, বৃক্ষরোপণ, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা- এসবই করে থাকি নিঃশব্দে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। অনেক ভাই ভর্তি ফি জোগাড় থেকে শুরু করে বই বিতরণ পর্যন্ত কাজ করেন নিরলসভাবে। আমাদের অনেকেই নিজ উদ্যোগে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে স্থানীয় পর্যায়ে মানবসেবায় নিয়োজিত।
সম্প্রতি নোয়াখালীতে আমরা আয়োজন করেছি ‘ইবনে আউফ কমার্স কার্নিভাল ২০২৫’। এখানে দিনব্যাপী চলেছে শিক্ষামূলক প্রতিযোগিতা, অর্থনীতি-বাণিজ্যভিত্তিক প্রদর্শনী, অতিথি বক্তৃতা এবং শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল উপস্থাপনা। এসব আয়োজনের মাধ্যমে আমরা তরুণদের মাঝে উদ্যোক্তা মানসিকতা, আর্থিক সচেতনতা ও জ্ঞানের চর্চা বাড়াতে কাজ করছি।
প্রতি বছরই আমরা কৃতী শিক্ষার্থীদের সম্মাননা প্রদান করি, ট্যালেন্ট সার্চ আয়োজন করি, যাতে শিক্ষার্থীরা উৎসাহ পায় এবং জাতি পায় মেধাবী ভবিষ্যৎ। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, ছাত্রশিবির কেবল রাজনৈতিক সংগঠন নয়; এটি একটি আদর্শভিত্তিক স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখান একাডেমিক যোগ্যতার পাশাপাশি রাজনৈতিক সচেতনতা, নৈতিকতা, সেবা ও নেতৃত্ব একসঙ্গে বিকশিত হয়।
আমাদের লক্ষ্য একটাই- জাতিকে শিক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে উপযোগী, সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব উপহার দেওয়া। দীর্ঘমেয়াদে আমরা এমন নেতৃত্ব তৈরি করছি, যারা ছাত্রজীবন পেরিয়ে জাতীয় রাজনীতিতেও সুস্থধারার নেতৃত্ব দিতে পারবে। সদ্যসমাপ্ত জুলাই বিপ্লবে ছাত্রশিবিরের বর্তমান নেতৃত্ব যে বলিষ্ঠতা দেখিয়েছে, তা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। ইনশাআল্লাহ, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও দায়িত্বশীলদের অনেককে আমরা সংসদে দেখবো। ইতোমধ্যেই শিবিরের একাধিক সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- শিবিরের গড়া নেতরা ক্ষমতার লোভে নীতি বিসর্জন দেয় না। বরং সততা, আদর্শ ও দেশপ্রেম অটুট রেখে ধীরে ধীরে তারা নেতৃত্বের উচ্চস্তরে এগিয়ে যাচ্ছে।
শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ছাত্রশিবির তার সক্ষমতা দেখিয়েছে। শিবির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইসলামী ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং সেখানে নেতৃত্বও দিয়েছে। আমাদের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের ওওঋঝঙ-এর (আন্তর্জাতিক ইসলামী ছাত্র সংগঠনের ফেডারেশন) সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে ওওঋঝঙ-এর সেক্রেটারি জেনারেলও ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছাত্রশিবির বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এটি প্রমাণ করে- ছাত্রশিবির কেবল জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা রাখে। এই মহান দায়িত্বে ছাত্রশিবির তার ভূমিকা আগেও রেখেছে, এখনো রাখছে, ভবিষ্যতেও রাখবে ইনশাআল্লাহ।
সোনার বাংলা: ইসলামী ছাত্রশিবিরের মৌলিক দাওয়াতটা কী, একটু বিস্তারিত বলবেন?
জাহিদুল ইসলাম: আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছি, আমরা আদর্শ ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চাই। আমরা মনে করি, আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজন আদর্শ নাগরিক ও নেতৃত্ব। এ লক্ষ্যেই ছাত্রশিবির সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরির ভিশন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা শিক্ষার্থীদের মেধা ও সততার ভিত্তিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ সবার জন্য একটি ইনসাফভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের দিকে ডাকছি। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য থাকবে সমান সুযোগ, ন্যায়বিচার এবং মর্যাদা। ছাত্রসমাজের কাছে আমরা এ আহ্বানই পৌঁছে দিচ্ছি। ছাত্রশিবিরের প্রত্যেক নেতা-কর্মী-সমর্থক এ কাজটি করছেন। অভিভাবকদের প্রতিও আমাদের আহ্বান সন্তানকে আপনার স্বপ্ন বাস্তবায়নের উপযোগী করে গড়তে ইসলামী ছাত্রশিবিরের পতাকাতলে সমবেত হতে সাহায্য করুন।
সোনার বাংলা: একজন ছাত্রের জ্ঞানার্জন ও ছাত্রসংগঠনের কাজের মধ্যে সমন্বয়টা কি করা হচ্ছে?
জাহিদুল ইসলাম: ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা। এর অনুসারীদের জীবনেও এ ভারসাম্যের প্রভাব পড়াই প্রত্যাশিত। আমরা সে সকল জনশক্তিকে আমাদের আদর্শ জনশক্তি মনে করি, যারা নিজেদের একাডেমিক পড়াশোনা এবং সাংগঠনিক কাজের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেন। আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের অনেক জনশক্তি এ ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেধাতালিকা বিশ্লেষণ করলে আপনি চিত্রটি দেখতে পাবেন। আমাদের যে সকল ভাই একাডেমিক পড়াশোনা এবং সাংগঠনিক কাজের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছেন না, তাদেরও ভারসাম্য অর্জনের জন্য আমরা উদ্বুদ্ধ এবং সহযেগিতা করার চেষ্টা করি।
সোনার বাংলা: বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় যেমন এমআইটি, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্রশিবিরের সদস্য সাথীদের লেখাপড়ার কোনো সুযোগ হচ্ছে কি?
জাহিদুল ইসলাম: জি¦, এরকম বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানগুলোয়ও আমাদের সাবেক ও বর্তমান সদস্য-সাথীরা পড়াশোনা করতে যাচ্ছেন। এ যাওয়ার পরিমাণ যেন সামনে আরও বাড়ে, এর জন্য আমরা জনশক্তিদেরকে বিদেশে উচ্চশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা, তাদের গাইড ও সহযোগিতা করাসহ অনেক ধরনের কাজ করে যাচ্ছি। মেধার বিকাশের মাধ্যমে বিশ্বমানবতার কল্যাণে সৎ, দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন জনশক্তি তৈরি করা আমাদের অন্যতম প্রধান কাজ বলে আমরা মনে করি।
সোনার বাংলা: দেশের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
জাহিদুল ইসলাম: দেশের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বলতে চাই, আপনারাই দেশের ভবিষ্যৎ, জাতির মূল চালিকাশক্তি। ছাত্রজীবনে জ্ঞান অর্জন করে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। ৫ আগস্টের বিপ্লবের আগে দেশে যে দমবন্ধ অন্ধকার ছিল, তা আজ কেটে গিয়ে একটি নতুন ভোর এসেছে। এ সুবর্ণ সুযোগকে কতটা কাজে লাগানো যাবে, তা নির্ভর করছে আমাদের ওপর। অতীতে আমরা অনেক সময় নষ্ট করেছি, কিন্তু এখন আর সময় নষ্ট করার অবকাশ নেই।
প্রথমত, পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে হবে। শুধু ডিগ্রি নয়- জ্ঞান, দক্ষতা ও চিন্তাশীলতা অর্জনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা বাড়ছে- সেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। যার যার বিষয়ে জ্ঞানের গভীরতা অর্জন, পাশাপাশি ইতিহাস, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কেও জানতে হবে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, অলিম্পিয়াড, লেখালেখি ও গবেষণার সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে। ‘প্রযুক্তি শেখো, ভাষা শেখো, যোগাযোগ দক্ষতা বাড়াও। তোমাদের মেধা ও পরিশ্রমই একদিন বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসনে নিয়ে যাবে।’ এই হচ্ছে আমাদের দিকনির্দেশনা।
দ্বিতীয়ত, একাডেমিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি চরিত্র গঠনের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু ভালো ফল নয়, ভালো মানুষ হওয়া জরুরি। আলোকিত চরিত্র ছাড়া জ্ঞান মূল্যহীন হয়ে পড়ে। মিথ্যা, দুর্নীতি ও অন্যায় থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। মাদক আজ ছাত্রসমাজ ধ্বংসের বড় ফাঁদ- এর ধারে-কাছেও যাওয়া যাবে না। নিজে সৎপথে থেকে, বন্ধু ও প্রতিবেশীকেও ভালো পথে উৎসাহ দিতে হবে।
তৃতীয়ত, অধিকার ও ন্যায়ের পক্ষে সাহসের সঙ্গে দাঁড়াতে হবে। ছাত্রসমাজ জাতির বিবেক। যখনই অন্যায়-অবিচার দেখবে, প্রতিবাদ করতে হবে। ব্যক্তিগত পার্থক্য ভুলে সমষ্টিগত কল্যাণে ঐক্য গড়তে শেখো। মনে রেখো, ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ- সবখানেই ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। আজকের স্বাধীনতা, বাংলায় কথা বলার অধিকার ও পরিবেশ- সবকিছুর পেছনে রয়েছে ছাত্রদের রক্ত-ঘামে লেখা ইতিহাস। সেই ঐতিহ্যের ধারক হয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। কেউ গুজব ছড়ালে বা বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করলে তা জ্ঞান ও বিবেচনায় মোকাবিলা করা দরকার। বিভাজনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে ধর্ম, অঞ্চল বা দল নয়, আমাদের সবার পরিচয় আমরা বাংলাদেশি, আমরা একই জাতির সন্তান। এ চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি ও সহনশীলতার বাতাবরণ গড়ে তুলতে হবে।
সব শেষে বলব, জুলাই আমাদের জাতীয় জীবনে নিয়ে এসেছে এক বিরাট পরিবর্তন। নিজেদের মাঝে জুলাইয়ের স্পিরিটকে লালন করতে হবে। জুলাইয়ের শহীদদের স্বপ্ন পূরণের জন্য কাজ করতে হবে। আপনাদের ওপর আমাদের অগাধ আস্থা। আগামী দিনের বাংলাদেশ কেমন হবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করছে আজকের ছাত্রছাত্রীদের ওপর। আপনারাই হবেন আগামী দিনের চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, রাজনীতিক, বিজ্ঞানী, কবি- সব খাতেই নেতৃত্ব দেবেন আপনারাই। তাই নিজেকে সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তোলোর কোনো বিকল্প নেই।
আজকের ছাত্রসমাজ যদি আদর্শ, জ্ঞান ও ঐক্যের পথে এগিয়ে যায়, তবে বাংলাদেশকে কেউই আর থামিয়ে রাখতে পারবে না। নিজেদের বিশ্বাস ও লক্ষ্য নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ আপনাদের সহায় হোন আমীন।
সাপ্তাহিক সোনার বাংলাকে ধন্যবাদ।
সাপ্তাহিক সোনার বাংলা: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
নাম : জাহিদুল ইসলাম
পিতা : কাজী রাসু ইসলাম
মাতা : মর্জিনা বেগম
ঠিকানা : চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা।
পড়াশোনা : স্নাতক ও স্নাতকোত্তর (ইংরেজি বিভাগ), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর (এমবিএ-এইচআরএম), মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। বর্তমানে তৃতীয় স্নাতকোত্তর অধ্যয়নরত (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পরিচয় : কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। (২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সদস্য সম্মেলনে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে ২০২৫ সেশনের জন্য কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন)।
ইতোপূর্বে পালনকৃত দায়িত্বসমূহ : ইতোপূর্বে যথাক্রমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি, নারায়ণগঞ্জ মহানগর সভাপতি, কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় বিতর্ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক, কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্পাদক, কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ও সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালনের করেছেন।

Check Also

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয় করণ ঘোষনা বাস্তবায়নের দাবিতে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন ও স্মারক লিপি প্রদান

ফিরোজ হোসেন, সাতক্ষীরা : মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত অনুদানভুক্ত ও অনুদান বিহীন সকল …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।