তীব্র হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট: হিমশিম খাচ্ছে সরকার

॥ হাসনাইন জাবেদ॥
অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব আয় কমে যাওয়া, চালের দাম বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ না হওয়া, রফতানি পণ্যের সর্বোচ্চ বৃহৎ খাত তৈরি পোশাক রফতানিতে নতুন সংকট দেখা দেয়া আর সরকারি ঋণ বৃদ্ধিতে বেসরকারি খাতের ঋণ দিতে না পারার শঙ্কা তৈরি, বন্যা আক্রান্ত মানুষের জন্য খাদ্য ও ত্রাণ সরবরাহে উদ্যোগের ঘাটতিÑ সব মিলিয়ে চলমান অর্থনৈতিক সংকট ক্রমাগত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। অদক্ষ প্রশাসন ও অপচয়ে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে সরকার। বাজেট ঘাটতি মেটাতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) কাটছাঁট ও ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট সংশোধনের কথা ভাবছে বলে জানা গেছে।
আর রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় সরকারের ব্যাংক ঋণ গ্রহণ বেড়ে গেছে সম্প্রতি। মে ও জুন মধ্যবর্তী দেড় মাসে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে ব্যাংকিং খাত থেকে। সরকারের এমন আগ্রাসী ঋণ গ্রহণে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে বলে সতর্ক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইসঙ্গে সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে বিশেষ কৌশল নেওয়ার ও সরকারি খরচের অগ্রাধিকার ঠিক করার। একইসঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি অপ্রয়োজনীয় বড় প্রকল্পের খরচ স্থগিত রাখার।
আগামী বাজেটেও সরকার ব্যাংকসহ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। অর্থে টান লাগবে এমন বিবেচনা করেই ব্যাংক ঋণ বাড়ানোর পদক্ষেপে যাচ্ছে সরকার। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছেও ঋণ চেয়েছে সরকার।
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধিতে আমদানি ব্যবস্থাপনায় দ্রুত উদ্যোগ না নেওয়ায় গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না পাওয়ায় দেশে যেমন সব ধরনের বেকারত্ব বেড়েছে, ঠিক তেমনি কূটনৈতিক ব্যর্থতায় বিদেশে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি না হওয়ায় রেমিট্যান্স কমছে প্রতিনিয়ত। জাতীয় অর্থনীতির; বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় উপজেলা পর্যায়ে ব্যাংক আমানতের পরিমাণ কমে গেছে গত মার্চে।
এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রমেই দুর্বল হওয়ায় ৯৭-৯৮ টাকায় কিনতে হচ্ছে প্রতি ডলার, ১০ মাস পূর্বেও যা ছিল ৮৪-৮৫ টাকা। অন্যদিকে কূটনৈতিক ব্যর্থতার আরেকটি দিক উন্মোচন করেছে সিলেট ও উত্তরবঙ্গে আকস্মিক বন্যা। কোনো প্রকার ঘোষণা ছাড়াই রাতের আঁধারে ভারতের বাঁধের সব পানি ছেড়ে দেওয়ায় এ দুটি অঞ্চল বন্যার পানির নিচে চলে গিয়ে এখনো লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে রয়েছেন। সেখানে চলছে মানবিক বিপর্যয়। কিন্তু তাদের এ বিপদের সময়ে সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদদের দেখা মিলছে না পাশে গিয়ে দাঁড়াতে।
লাগামহীন মূল্যস্ফীতি
গত মে মাসে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে উঠেছে মূল্যস্ফীতির হার, যা গত আট বছরের সর্বোচ্চ। যদিও সরকারের এ মূল্যস্ফীতির হার নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ করে আসছে অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাদের মতে, বাস্তবে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে। কিন্তু সরকার তা গোপন করছে।
সরকারি প্রতিবেদনই বলছে, সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাবারের দাম। এ খাতে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে মে মাসে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির এই হিসাবের গত বছরের মে মাসে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিলেন, এ বছর মে মাসে তা কিনতে ১০৭ টাকা ৪২ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
গত বছরের মে মাসে দেশে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এই হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার। তবে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশে ওঠে। পরের মাসেই তা ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে উঠল।
এর ফলে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের সংসার খরচ মেটাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। এর আগে ২০১৪ সালের মে মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এরপর আর কখনো এতটা চড়েনি অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ সূচক।
বিবিএসের ন্যাশনাল একাউন্টিং উইংয়ের পরিচালক মো. জিয়াউদ্দীন আহমেদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে দেশের প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দাম বৃদ্ধি। বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হিসাব নির্ণয়ন ঝুড়িতে চালের দামই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যাংক ঋণমুখী সরকার
রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় অর্থের চাহিদা মেটাতে সরকার অর্থবছরের শেষ সময়ে ব্যাংক ঋণমুখী হয়েছে। সরকারি ঋণের চাপে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার অনেক বেড়ে গেছে সাম্প্রতিক সময়ে। চলতি অর্থবছরের গত এপ্রিল পর্যন্ত যেখানে সরকারের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা, তা জুনের মাঝামাঝি সময়ে বেড়ে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।
সরকারের এমন ঋণ গ্রহণের ফলাফল নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি প্রতিবেদন দিয়েছে সরকারকে। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সরকারের ঋণ গ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ইতোমধ্যে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার অতীতের চেয়ে বেশি বেড়েছে, যা ব্যাংকের ঋণ সুদহার বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির প্রবণতাকে আরো উসকে দিতে ভূমিকা রাখবে। এটি সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার দিক দিয়ে কাম্য নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সতর্কবার্তার পরপরই মে মাসে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে। আগামী কয়েক মাসে আরও বাড়বে বলেই বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে।
এজন্য বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা ও কিছু উচ্চ ব্যয়ের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের ব্যয়ে স্থগিত করতে কৌশল নির্ধাণের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন ঋণ গ্রহণ বাড়ছে
সরকারের রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহসহ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে (এডিপি) অর্থের সংকটে পড়তে হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের আমানত কমে গেছে ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থসংকটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ছুটতে হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে।
এমনকি বাজেট বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমএফের কাছে ছুটছে সহায়তার জন্য। গত এক দশক পূর্বে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এমন ছিল যে, বাজেট বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ ঋণ ছাড়া আর কোনো জায়গা থেকে সহায়তা নিতে হতো না।
এক দশকে ধীরে ধীরে সেই সক্ষমতা হারিয়েছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘাটতি মেটাতে আইএমএফের কাছে সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ সরকার। চলতি অর্থবছরের জন্য ১০০ কোটি ডলার বা ৯৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তা চেয়েছে। আর আগামী কয়েক বছরের জন্য ৮ লাখ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আইএমএফ ও বাংলাদেশ সরকার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
আগে সঞ্চয়পত্র থেকে বড় ধরনের সহায়তা পেত অর্থের জোগানে। কিন্তু কড়াকড়ি আরোপ করায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে মানুষ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন বলছে, রাজস্ব আদায় কমে গেছে। কিন্তু সরকার এখনো ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সংশোধন আনেনি। এখন সরকারকে যদি ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্য পূরণ করতে হয়, তাহলে অর্থবছরের শেষের দিকে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আরো অনেক ঋণ নিতে হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারি ঋণ বৃদ্ধি মানেই হলো মূল্যস্ফীতির ওপর আরো চাপ বেড়ে গিয়ে নাকাল হবে সাধারণ মানুষ; বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সরকারি অর্থ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে না। আর সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। ফলে কর্মসংস্থানে আরো চাপে পড়বে অর্থনীতি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ইতোমধ্যে ব্যাংক সুদহার মূল্যস্ফীতির নিচে রয়েছে। এর মানে হলো মানুষের সঞ্চয়প্রবণতা কমে যাবে, ব্যাংকে তারল্য সংকট আরো বাড়বে। এর ইঙ্গিত দেখা মেলে কলমানি মার্কেটের সুদহারে। ১-২ শতাংশের ঘরে থাকা কলমানি মার্কেটে সুদহার এখন ৫ শতাংশের ওপরে উঠেছে।
এমন প্রেক্ষাপটের পেছনে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ কমে যাওয়া ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা, প্রকল্পে অপচয়, অনিয়মকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। আর সার্বিকভাবে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়ছে বলে মনে করেন তারা।
সংকট সমাধানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও গণতন্ত্রের উন্নয়ন হওয়া প্রয়োজন বলে নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে আসছেন সকল মহলের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, সম্মিলিতভাবে রাজনৈতিক দলগুলো চেষ্টা করলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এজন্য প্রয়োজন সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি সংলাপ। এটির উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। নইলে দেশের আর্থিক অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতোও হতে দেরি লাগবে না বলেই মনে করছেন তারা।

Please follow and like us:

Check Also

খুলনায় ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে পানি ও খাওয়ার স্যালাইন বিতরণ

খুলনায় প্রখর তাপদাহে ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থী ও পথচারীদের মাঝে  পানি ও খাওয়ার স্যালাইন বিতরণ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।