বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দিলে নানা ঘটনার পর ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতা নেয় সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সরকারের দুই মাস পূর্তি না হতেই মার্চ থেকে ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে মূল্যস্ফীতি। এ সময় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার বাজার মানিটরিং, গুদামগুলোতে অভিযান শুরু করে। এতসব করেও বাজার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। উল্টো ওই বছরের ডিসেম্বরে রেকর্ড ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশে ওঠে মূল্যস্ফীতি।
একই পথে হেঁটেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। পণ্য সংকট, সিন্ডিকেটসহ নানা কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি শুরু হলেই কয়েকটি বাজারে খুচরা ব্যবসায়ীদের জরিমানা করেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে। মাঝেমধ্যে কিছু কিছু নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে মূল্যস্ফীতি কম দেখাতে ভুয়া হিসাবায়নও করে বিগত সরকার। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরও সেই পুরোনো নিয়মেই বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিছু নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও সেগুলো কেউই মানছে না। মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হচ্ছে, কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণের মূল কাজ না করে জনপ্রিয় অভিযানেই সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ সীমাবদ্ধ। এতে উপকৃত না হয়ে উল্টো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষি, ক্রেতা ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। করোনা-পরবর্তী বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকট তৈরি হলে বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে। ডলার সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ অন্যান্য কারণে দেশের পণ্য বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েও আড়াই বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। বাধ্য হয়ে গত বছরের জুলাই মাসে সুদহারের সীমা তুলে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর তিন ধাপে বাড়ানো হয় নীতি সুদহার। কিন্তু কোনোভাবেই কমেনি মূল্যস্ফীতি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে সুদের হার তিন ধাপে বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় কোনো উন্নয়ন দেখাতে পারেনি। সরকার গঠনের পর কয়েকদিন চাঁদাবাজি বন্ধ থাকায় পণ্যমূল্য কিছুটা কমলেও সময় যত বেড়েছে চাঁদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পণ্যের দামও। আগের তুলনায় বিভিন্ন স্থানে চাঁদার হারও বেড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানতে চাইলে মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির একজন শীর্ষ নেতা কালবেলাকে বলেন, আগেও বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসায়ীদের চাঁদা দিতে হতো। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর এটা কিছুদিন বন্ধ ছিল। ফের চাঁদা সংস্কৃতি চালু হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, এখন চাঁদা গুনতে হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। এর প্রভাব পড়ছে পণ্যের দামে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট আছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন কালবেলাকে বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আমাদের যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। অনেক ক্ষেত্রে আইন পরিবর্তনেরও প্রয়োজন আছে। আবার সরকার পতনের পর চাঁদাবাজি কিছুটা কমেছিল। এখন সেটা অন্যপক্ষ দখলে নিয়েছে বলে অভিযোগ শুনছি।
২০২২ সালের রমজানের আগে ও ঈদের পরে কয়েক দফায় বাড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। ঈদের পর ২৫ কেজি বস্তার চিনিগুঁড়া চালের দাম ১ হাজার ৯৫০ থেকে বেড়ে ২ হাজার ৩৫০ টাকায় বিক্রি শুরু হয়। ৫০ কেজি ওজনের মিনিকেট চালের বস্তা ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা, স্বর্ণা চাল ১ হাজার ৯৫০ থেকে ২ হাজার ১৮০ টাকা, পাইজাম চাল ২ হাজার ১২০ থেকে ২ হাজার ৩৫০ টাকা, আটাইশ ২ হাজার ১৭০ থেকে ২ হাজার ২৭০ টাকায় বিক্রি হয়। অর্থাৎ ওই সময় বিভিন্ন চালের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা। শুধু চাল নয়, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, রসুনসহ বাড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম। এর পরই সরকারের নির্দেশে ভোক্তা অধিকার বিভিন্ন বাজারে অভিযান শুরু করে। জরিমানা করা হয় হাজার হাজার টাকা। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে কমেনি পণ্যের দাম। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে ব্যাপক হারে সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। পরে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, দেশে চালের বাজারে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে সিন্ডিকেট আছে, তা ভাঙা সম্ভব নয়। এজন্য বাজারের নিয়ন্ত্রণে তথ্য পেতে সাংবাদিকদের সহযোগিতা চান তিনি।
শুধু ২০২২ সালেই নয়, বাজারের নিয়ন্ত্রণে পণ্য বাজারে অভিযানের ইতিহাস দীর্ঘ। বিভিন্ন সময় সরকার লোক দেখানো এসব অভিযান পরিচালনা করলেও বাস্তবে সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজারের নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা প্রতিযোগিতা কমিশন বাংলাদেশে একযুগেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না। গণমাধ্যমে লেখালেখি শুরু হলে লোক দেখানো কিছু অভিযান আর হাতেগোনা কয়েকটি মামলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ প্রতিযোগিতা কমিশনের কাজ। এজন্য বাজারের নিয়ন্ত্রণে প্রতিযোগিতা কমিশনকে কার্যকর করার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।
বাজার নিয়ন্ত্রণের জনপ্রিয় অভিযান ও প্রতিক্রিয়া: ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের পণ্য বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। বিশেষ করে চালের দাম দ্রুত সময়ের মধ্যে বাড়তে শুরু করলে বিভিন্ন বাজারে অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযান শুরু হয় বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত চালের গুদামগুলোতে। কিন্তু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি সরকার। উল্টো পণ্যের দাম আরও বেড়ে যায়। এ সময় অনেক ব্যবসায়ী বস্তা ধরে চাল নদীতে ফেলে দেন বলেও অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু তাও কমেনি পণ্য বাজার। শুধু তৎকালীন সরকারই নয়, এর আগে এরশাদ সরকারের আমলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হলে তারাও এ ধরনের জনপ্রিয় অভিযান পরিচালনা করেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য থেকে পাওয়া যায়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও বিভিন্ন সময় বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে চালানো হয়েছে লোক দেখানো অভিযান। বিশেষ করে করোনা-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি বাজার। আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর মানুষের অস্বস্তির অন্যতম কারণও এই বাজার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ: বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনা সমস্যার কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের কারণে কষ্টে আছে। এখন তাদের স্বস্তির জন্য মূল্যস্ফীতি কমালে চলবে না। পণ্যের মূল্য কমাতে হবে। মূল্যস্ফীতি হচ্ছে গত বছরের মূল্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি কমা মানে গত বছরের চেয়ে মূল্য এত শতাংশ কমেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য তো মূল্যস্ফীতি কমালে চলবে না। তাদের জন্য পণ্যের মূল্য অর্থাৎ চাল, ডাল, পেঁয়াজ, তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্য কমাতে হবে। নিত্যদিনে মানুষের খাবারের টেবিলে যে খাদ্যগুলো থাকে, সেগুলো দাম কমাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বলেন, মূল্য কমাতে হলে বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনার বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে বন্ধ করতে হবে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমাতে হলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে হবে। বর্তমান সরকার যেই কৌশলে বাজার ব্যবস্থাপনা করছে, তার সঙ্গে আগের সরকারের কৌশলে কোনো পার্থক্য নেই। ডান্ডাবাজি করা হচ্ছে খুচরা বিক্রেতাদের ওপর। অথচ যেখান থেকে বাজারের নিয়ন্ত্রণ, সেখানে হাত দেওয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশ বাজার ব্যবস্থাপনার যে ধারণা রয়েছে, এটা পুরোটাই ভ্রান্ত। সব সরকারই এই কৌশল নিয়েছে। যেটা মূলত কাজ করে না।
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের ডিন অধ্যাপক এনামুল হক কালবেলাকে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারগুলো সবসময় জনপ্রিয়তা তৈরির জন্য অভিযান পরিচালনা করে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে কোনোভাবেই মূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এজন্য দরকার প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করা, বাজার প্রতিযোগিতামূলক করা এবং চাঁদাবাজি বন্ধের ব্যবস্থা করা। বাজারে কোনো কোম্পানি বা গোষ্ঠী প্রতিযোগিতা নষ্ট করছে কি না, মূল্য বৃদ্ধিতে সিন্ডিকেট করছে কি না, বাজার কেন অস্থিতিশীল হচ্ছে—সে বিষয়ে কাজ করে প্রতিযোগিতা কমিশন। এটা মিডিয়ায় লেখার আগেই বাজারে কী ধরনের সমস্যা আছে বা তৈরি হতে পারে, সে বিষয়ে তাদের গবেষণা থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এজন্য বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে হলে প্রতিযোগিতা কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে।