জনগণের আস্থায় দু’দল

ক্রাইমবার্তা রিপোট: ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটু ঘুরিয়ে বলা যায় ‘বাংলাদেশের যা কিছু সফলতা-ব্যর্থতা জনসমর্থন/ আওয়ামী লীগে অর্ধেক তার অর্ধেকের বিএনপিতে মন’। নিন্দুকেরা যতই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতি নিন্দার ঝড় তুলুক; সমালোচনা-বিতর্ক করুক; দেশের মানুষের হৃদয়ে এই দুই দল ছাড়া অন্য কোনো দল যায়গা পায়নি। প্রায় তিন যুগ ধরে এই চিত্র। দুই দলের ব্যর্থতাকে পুঁজি করে বিকল্প শক্তি, তৃতীয় ফ্রন্ট নানা নামে জনগণকে টানার চেষ্টা হয়েছে; কেউ সুবিধা করতে পারেনি। চলার পথে বিভিন্ন সময় দুই দলই সুনামীতে পড়েছে; রক্তাক্ত হয়েছে; জনসমর্থন হারায়নি। সফল্যের উল্টো পীঠ ব্যর্থতা এবং বিতর্কের মুখে পড়েছে কিন্তু জনসমর্থন টুটে যায়নি। এমনকি ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের শাসনামলে সংস্কারের নামে দুই নেত্রীকে নাই করতে ‘মাইন্যাস-২’ থিউরি ধোঁপে টেকেনি। বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলের সংখা ৪০। এর বাইরেও রয়েছে প্রায় শতাধিক রাজনৈতিক দল। ২ লাখ ৪৬ হাজার ৩৭ বর্গকিলোমিটারের মানুষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে যায়নি; সমর্থন দেয়নি। নানা চড়াই-উৎরাই, অনুকূল-প্রতিকূল শ্রোতে ভাসলেও এখনো দেশের জনগণের ঠিকানা দু’টি দল। 5
’৮০ দশক থেকে দেশের রাজনীতিতে অনেক বিবর্তন ঘটেছে। নানান চমক দিয়ে অসংখ্য নতুন নতুন দল আত্মপ্রকাশ করেছে। সাময়িকভাবে দু’একটি দল জনমনে ঝাকুনি দিলেও জনসমর্থন পায়নি। বর্তমানের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি’র জনসমর্থনের ঢেউ এ ভাটার টান ধরাতে পারেনি। দেশের রাজনীতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক অগ্রগতি, শৃংখলায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রয়েছে অনেক অবদান। সাফল্যের তালিকায় দুই দলের অবস্থা ‘কেহ কারো নাহি ছাড়ে সমানে সমান’ প্রবাদের মতোই। সু-সময়ে দুই দলে জনসমর্থন বেড়েছে; কিন্তু দুর্দিনে ‘নিজস্ব জনসমর্থনে’ নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাফল্য নিয়ে ‘মহাকাব্য’ লেখা সম্ভব। কিন্তু সে পথে না গিয়ে উল্টো চিত্র তথা দুই দলের ব্যর্থতা, অদূরদর্শিতা, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা, বিতর্ক, নাজুক পরিস্থিতি, চলার পথে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে। সেখানেও দেখা যায় জনসমর্থনের ক্ষেত্রে তাদের বাইরে কোনো শক্তি সৃষ্টি হয়নি। দুই দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে বিতর্ক আছে, দলীয়করণ, আত্মীয়করণ, পক্ষপাতিত্ব, নির্বাচনের সময় অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন বাণিজ্য, অস্ত্র-পেশী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা, জনমত উপেক্ষা করা, জনগণের প্রতি আস্থার বদলে বিদেশী শক্তির উপর নির্ভরশীলতা, বিদেশী দূতাবাসে নালিশ দেয়াসহ হাজারে অভিযোগ রয়েছে দুই দলের বিরুদ্ধে। তারপরও মানুষ তাদের ছেড়ে যায়নি। বরং সময়ে অসময়ে তাদের জনপ্রিয়তার পারদ বাড়ছে তো বাড়ছেই। ক্ষমতা কেন্দ্রীয় রাজনীতি চর্চা করায় তাদের বিরুদ্ধে অশ্লীল-কাদা ছোঁড়াছুড়ির রাজনীতি চর্চার অভিযোগ উঠেছে; তারপরও মানুষের পছন্দের তালিকা থেকে বাদ যায়নি। অনেকের কাছে অপ্রিয় হলেও সত্য যে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া এই দুই নেত্রী দেশের মানুষের কাছে নেতৃত্বের আইডল। দেশের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ তাদের বাইরে অন্য কারো নেতৃত্ব কল্পনাই করে না।
আওয়ামী লীগের কথাই ধরা যাক। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেয়া দলটি’র ৬৬ বছরে আছে অনেক অর্জন। সমসাময়িক সময়েও অর্জনের তালিকা দীর্ঘ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দলটির সাফল্য নিয়ে যেমন আলোচনা হয়; তেমনি ব্যর্থতা নিয়েও বিতর্ক হয়। ‘সু-সময়ে অনেকে বন্ধু বটে হয়/ অসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয়’ প্রবাদটি সত্য ধরলে সু-সময়ে দলের প্রতি জনসমর্থন বাড়বে সেটাই স্বাভাবিক। দলটির ‘ইতিবাচক’ দিকের বদলে ‘নেতিবাচক’ ভূমিকার দিকে তাকালে দেখা যাবে ক্ষমতায় যাওয়ার পর দলটি জনগণ থেকে দূরে সরে গেছে। অনেক এমপি নির্বাচনী এলাকায় পুলিশ প্রহরা ছাড়া যেতে পারেন না। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোটের অধিকার হারিয়েছে। উপ-নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনের অধিকাংশে দলটির প্রার্থীরা কেন্দ্র দখল, ভোট ডাকাতি করে বিজয়ী হয়। মিডিয়ায় সে চিত্র প্রকাশও পায়। ক্ষমতায় আসার পর দলটির কেন্দ্র থেকে শুরু করে শেখড় পর্যায়ের নেতা এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজী, রক্তারক্তিতে মানুষ অতিষ্ঠ। দলটির অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের নেতারা নিজেদের মধ্যে রক্তরক্তি করে নিজ দলের প্রায় ৬০ জনকে হত্যা করেছে। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং প্রশাসনকে নিজেদের দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করে ‘জনতার কাঠগড়ায়’ দাঁড়ানোর উপক্রম হয়েছে। দেশে বিদেশে দলটির ভাবমর্যাদা মারাত্মকভাবে নষ্ট হয়েছে। ক্ষমতায় থাকায় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অনৈতিকভাবে ব্যবহার করে দুর্নাম কুড়িয়েছে। তারপরও দেশের জনগোষ্ঠির বৃহৎ একটি অংশ আওয়ামী লীগকে ঘিরে রেখেছে। বিতর্ক-সমালোচনা এবং নানা শ্রোত-ঢেউ দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠিকে আওয়ামী লীগ থেকে এক চুলও বিচ্যুত করতে পারেনি। বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দলটির সমমনা আরো কয়েকটি দল দেশে রয়েছে। সিপিবি, বাসদ, গণফোরাম, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণতন্ত্রী পার্টিসহ অনেকগুলো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মতোই প্রগতিমনা। ওই সব দলে জাঁদরেল, জাঁদরেল নেতাও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দলগুলোর নেতারা দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের কথা সর্বদাই বলে থাকেন। গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে তাদের চিন্তার অন্ত নেই। তারপরও সাধারণ মানুষ ওই সব দলকে আওয়ামী লীগের বিকল্প ভাবছে না। বরং যাদের নিয়ে উল্লেখিত দলগুলোর চিন্তার অন্ত নেই সেই কৃষক-শ্রমিক, অবহেলিত-বঞ্চিত মানুষ তাদের পক্ষে যায় না। দলটির নেতা-কর্মী-সমর্থকরা নিজেরা বিরোধ করেন, তারপরও আওয়ামী লীগ ছেড়ে যান না। ২২ ও ২৩ অক্টোবর দলটির ২০তম কাউন্সিল হয়েছে। অতপর দলটির জনমানুষের মন জয়ের চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে জনসমর্থনের দিক দিয়ে ১৯৭৮ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে জন্ম নেয়া বিএনপির অবস্থাও প্রায় অভিন্ন। প্রায় ১০ বছর ধরে দলটি ক্ষমতার বাইরে। তিন বছর ধরে সংসদে নেই। দলটির সারাদেশের নেতাকর্মীদের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে আইল্যা-সিডর-সুনামী। হামলা-মামলা, জেল-জুলুম, খুন-গুম এমন কোনো নির্যাতন নেই দলটির নেতাকর্মীদের ওপর হয়নি। দলটিকে একাধিকবার দ্বিখ-িত করারও চেষ্টা হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা ঝুলছে। সভা-সমাবেশ করতে না দেয়ায় বু্িদ্ধজীবীদের ভাষায় দেশের রাজনীতি থেকে দলটি কার্যত ‘উধাও’ হয়ে গেছে। তারপরও দলের জনসমর্থন কমেনি এবং দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী দলটির সঙ্গে রয়েছে। রাজনৈতিক কারণেই হঠাৎ হঠাৎ করে দলটির ওপর জুলুমের দমকা হওয়া বয়ে গেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দলটি বর্তমানে সাংগঠনিক কর্মকা-ে নীরব। এতে দলের জনসমর্থনে সামান্য ভাটার টান পড়েনি। বরং সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কর্মী সমর্থকরা নীরবতা পালন করছেন। গত ৩ বছরের চিত্র দেখা যায় দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে হয়েছে ১৯টি মামলা। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলার সংখ্যা ৫। বাকিগুলো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় করা সহিংসতা, নাশকতা, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির মামলা। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হয়েছে ১১টি মামলা। মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে ছিল ৭টি মামলা। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে সারাদেশে ৮৪টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া সিনিয়র নেতাদের মধ্যে রফিকুল ইসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে ৮৩টি, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৫৩, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে ২৩, সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে ৩৪টি, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিসহ কয়েকজন নেতা প্রত্যেকের বিরুদ্ধে প্রায় শতাধিক করে মামলা হয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে সারাদেশে নাশকতার অভিযোগে প্রায় ৫ হাজার মামলা দায়ের করা হয়। সরকারের প্রতিহিংসামূলক আচরণে সাংগঠনিকভাবে বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়ে দলটি। ভয়ভীতি, প্রলোভন দেখিয়ে কিছু নেতাকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টার খবর মিডিয়ায় আসে। এতোকিছুর পরও দলের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। সারাদেশের কর্মী-সমর্থকরা বিচ্ছিন্ন হননি। অথচ বিএনপির মতো জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল জাতীয় পার্টি অনেক চেষ্টা করছে সমর্থক-ভোটারদের নিজেদের দিকে নিতে। এ ক্ষেত্রে তারা সরকারের সহায়তাও নেয়ার চেষ্টা করছে; সুবিধা করতে পারেনি। বরং এরশাদের আহ্বানকে তারা ঘৃর্ণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। চরম দুর্দিনের মধ্যেও নির্বাচন এলে বিএনপির প্রার্থী হওয়ার জন্য ফরম কিনতে দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। অথচ জাতীয় পার্টি প্রার্থীর অভাবে অনেক আসনে ভোট করতে পারে না। নির্বাচনে প্রার্থী দেয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগে মনোনয়ন পেতেও দীর্ঘ লাইন পড়ে।
দেশের রাজনীতিতে দুই দলের বিকল্প প্লাটফর্ম হয়নি কেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন এবং সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, দেশের রাজনীতি দুই ধারায় বিভক্ত। এই ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। অন্য কোনো নেতা বা দল নিজস্ব কোনো কর্মসূচি দিয়ে জনগণের হৃদয় জয় করতে পারেননি। ফলে দুই দলের বর্তমান যে রাজনৈতিক অবস্থান তা আরো অনেক দিন থাকতে পারে। রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর ‘ভাল আছি ভাল থেকো/ আকাশের ঠিকানায় চিঠি লেখো’ কবিতার মতোই যে দেশের ১৬ কোটি মানুষ কেউ আওয়ামী লীগ ও কেউ বিএনপিকে তাদের ঠিকানা বেছে নিয়েছে। সে জন্যই তারা দুই দলকে সমর্থন করে। অন্য কোনো দল বা শক্তি মানুষের এই বিশ্বাসে ছেদ ঘটাতে পারছে না। ফলে দেশের রাজনীতি মূলত দুই বড় দলকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে।

Please follow and like us:

Check Also

অনিশ্চয়তার নতুন যুগে মধ্যপ্রাচ্য

ইউক্রেন-রাশিয়া রেশ কাটতে না কাটতেই ফিলিস্তিনের গাজায় শুরু হয় ইসরাইলি আগ্রাসন। এরপর থেকে অশান্ত হতে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।