ওবামা : সাফল্য-ব্যর্থতার খেরো খাতা

ক্রাইমবার্তা আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মাত্র তিন দিন পর হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায় নিচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের প্রথম কৃষাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। বিপুল জনপ্রিয়তা আর সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে ২০০৯ সালে শপথ নিয়েছিলেন বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে। বিদায় বেলায় এখন হিসেবের খেরো খাতা খুলে বসেছেন সবাই। কি পেল যুক্তরাষ্ট্র আর কি পেল না। তিনি কি নন্দিত হয়ে বিদায় নিচ্ছেন না নিন্দিত হয়ে বিদায় নিচ্ছেন। কত শতাংশ মানুষের কাছে ওবামা তার জনপ্রিয়তা নিয়ে বিদায় নিচ্ছেন।

প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তা বাড়া-কমা নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘গেলাপ’। তাদের দেয়া সর্বশেষ তথ্যানুসারী প্রেসিডেন্ট ওবামা ৫৮ শতাংশ জনপ্রিয়তা নিয়ে হোয়াইট হাউস ছাড়ছেন। যেখানে তার পূর্বসূরী জর্জ ডব্লিউ বুশ ক্ষমতা ছেড়েছিলেন ওবামার চেয়ে অনেক কম শতাংশ মানুষের জনপ্রিয়তা নিয়ে। ক্ষমতা ছাড়ার সময় বুশের জনপ্রিয়তা ছিল ৪০ শতাংশ। আর বিল ক্লিনটনের জনপ্রিয়তা ছিল ওবামার কাছাকাছি ৫৭ শতাংশ। অবশ্য এইচ ডব্লিউ বুশ ১৯৯৩ সালে ক্ষমতা ছেড়েছিলেন ৬২ শতাংশ জনপ্রিয়তা নিয়ে।

প্রেসিডেন্ট ওবমার কাজের সফলতা ও ব্যর্থতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দু’টি দৃষ্টি ভঙ্গিকে সামনে নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন। প্রথমত, আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপ। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় তার গৃহীত পদক্ষেপ। এতে বেশিরভাগ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একমত হয়েছেন যে, পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে প্রেসিডেন্ট ওবামা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। যার কারণে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশ্লেষক নীল গার্ডিনার মনে করেন, আমি প্রেসিডেন্ট ওবামার পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো কোনো সফলতা দেখতে পাচ্ছি না। বরং সার্বিকভাবে বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা দুর্বলই হচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের অবনতিই হচ্ছে।

এক্ষেত্রে তুরস্ক ও ইসরাইলের বিষয়টি অনেকেই উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছেন। তুরস্কে গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্যু-এর মাধ্যমে হঠানোর পেছনে-এ যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভালোভাবে নেননি। অপরদিকে ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে প্রেসিডেন্ট ওবামা সৈন্য সরিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু ইরাক থেকে এভাবে সৈন্য সরানো পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে বলে মনে করেন তারা।

শুধু তাই নয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে রাশিয়া। রাশিয়া থেকে এশিয়া কোথাও আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মিশরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়টিও অনেকে নেতিবাচক হিসেবেই গণমাধ্যমে তুলে ধরছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন নাইন-ইলেভেনের পর প্রেসিডেন্ট ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের সুরক্ষার বিষয়ে মনোনিবেশ করায় যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের কাছে জনপ্রিয়তা নিয়েই তিনি বিদায় নিচ্ছেন। কিন্তু মুসলিম বিশ্বে তার ভুল নীতি গ্রহণের কারণে তিনি ততটাই অজনপ্রিয়।

ওয়াশিংটন পোস্টের এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৫২ শতাংশ লোক মনে করে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ব্যর্থ হয়েছেন। আর মাত্র ৪২ শতাংশ লোক মনে করছেন তিনি সার্বিকভাবে একজন সফল প্রেসিডেন্ট। ব্যর্থতার খেরোখাতায় যেগুলো আলোচিত হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম আলোচ্য বিষয় হচ্ছে তিনি গোয়ান্তানামো বে কারাগার বন্ধ করতে পারেননি, যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে ব্যর্থ হন। বরং তার আমলেই সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেপুর্ট ( দেশ ত্যাগে বাধ্য) হন।

আরব বসন্তের সাথে তাল মিলিয়ে তিনি নীতি প্রণয়নে ব্যর্থ হন। যার কারণে আরবের লোকেরা বেশিরভাগই তাকে ঘৃণা করে- এমন মত রিয়াল ক্লিয়ার ফিউচারের সম্পাদক রবার্ট তাসিনিস্কির। মি. রবার্ট ওবামার ব্যর্থতার একটি বিশেষ দিক তুলে ধরে বলেন, বিশ্বে রাশিয়ার একনায়কতান্ত্রিক শাসক পুতিনের প্রভাব বৃদ্ধির বিষয়টি মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হন প্রেসিডেন্ট ওবামা। যে বিষয়ে ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মিট রমনি হুঁশিয়ার করেছিলেন। যা প্রেসিডেন্ট ওবামা অবজ্ঞা করেছেন।

অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সফল্যের পালকে অনেকে প্যারিসে জলবায়ু চুক্তি সম্পাদন ও ইরানের সাথে চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে ক্রেডিট দিতে চাইছেন। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সাফল্যের ক্ষেত্রে অনেকেই প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রশংসা করেছেন। কারণ অর্থনৈতিক মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে ওবামা অনেকটাই সফল হয়েছেন বলে অনেক বিশ্লেষক পরিসংখ্যান উপস্থাপন করছেন। ওবামা ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত ১১ মিলিয়ন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী রেডিও এনপিআর। তবে জনগণকে বক্তব্যের মাধ্যমে আন্দোলিত করার যে ক্ষমতা ওবামার রয়েছে তা নিয়ে কম-বেশ সবাই একমত।

তবে ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ব্যতিক্রম ধারার একজন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নিতে যাচ্ছেন। আর একারণেই ওবামার ব্যর্থতার আলোচনাটি জনমনে গৌণ বলেই মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ।

Please follow and like us:

Check Also

বেইজিং ঘনিষ্ট মুইজ্জুর জয়: ভারত থেকে আরও দূরে সরবে মালদ্বীপ

মালদ্বীপে দীর্ঘদিন ধরে থাকা ভারতের প্রভাব কমাতে ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগান দিয়ে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।