মেয়রদের সরাতে মরিয়া কেন সরকার?

সোহরাব হাসান

মেয়র এম এ মান্নান ও আরিফুল হককয়েক মাস আগে সুনামগঞ্জ গিয়েছিলাম প্রথম আলোর একটি গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। তাই সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে আসার পথে সিলেটে এক দিন থেকে যাই। সেখানকার রাজনীতির খোঁজখবর নিতে স্থানীয় রাজনীতিক-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করি। কথা হয় বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গেও। সবাই স্বীকার করলেন, দীর্ঘদিন মেয়র না থাকায় সিলেট অনেক পিছিয়ে পড়েছে। শহরের রাস্তাঘাট বেহাল।

২০১৩ সালের নির্বাচনে সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে পরাজিত করে জয়ী হন বিএনপি নেতা আরিফুল হক। কিন্তু তিনি নিয়মিত দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। মামলার কারণে জেলে গেছেন। মেয়রের অনুপস্থিতিতে অন্যান্য সিটি করপোরেশনে প্যানেল মেয়রেরা দায়িত্ব পেলেও সিলেটে তা হয়নি কাউন্সিলরদের বিরোধের কারণে। ফলে সিটি করপোরেশনের কাজ অনেকটাই থমকে ছিল। উচ্চ আদালতের নির্দেশে আরিফুল হক ফের মেয়রের আসনে বসলেও ভয়, কখন তাঁকে সরিয়ে দেয়।

সহকর্মী সুমনকুমার দাসকে নিয়ে মেয়রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি জানান, দীর্ঘদিন সিটি করপোরেশনের বাইরে থাকায় নগরবাসীই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি যেসব কাজ শুরু করেছিলেন, জেলে যাওয়ার পর সেগুলো আর এগোয়নি। তাঁর ওপর মামলার খড়্গ ঝুলছে।

কিন্তু না, গত দুই মাসে আরিফুল হকের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কোনো সাময়িক বহিষ্কারাদেশের চিঠি জারি করেনি। করেছে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র এম এ মান্নানের প্রতি। একটি মামলায় অভিযোগপত্র পেশ করার পরিপ্রেক্ষিতে ৬ জুলাই মন্ত্রণালয় তৃতীয়বারের মতো তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। মামলাটি দুর্নীতির।

এম এ মান্নান একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি। আর যিনি তাঁকে সাময়িক বরখাস্তের চিঠি দিয়েছেন, তিনি একজন জুনিয়র আমলা। তাও একটি নয়, চার চারটি সিটি করপোরেশনের মেয়রকে এভাবে স্বৈরাচারী কায়দায় বহিষ্কার করা হয়েছে। আর প্রতিবারই উচ্চ আদালত সেই আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করে তাঁদের পুনর্বহাল করেছেন।

নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি এ কেমন আচরণ সরকারের? এই চার সিটি করপোরেশনে যদি আওয়ামী লীগ-সমর্থক মেয়র থাকতেন, তাহলে কি মামলার কারণে বরখাস্ত করা হতো? অনেক সাংসদ এবং সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির মামলা আছে। কিন্তু তাঁদের কাউকেই ‘সাময়িক বরখাস্ত’ করা হয়নি। আইন সরকারি দলের নেতাদের জন্য এক রকম, আর বিরোধী দলের নেতাদের জন্য অন্য রকম।

গাজীপুরে মেয়রের বরখাস্ত আদেশ ও প্যানেল মেয়রের গদিনসিন হওয়ার মধ্যেও আছে গূঢ় রহস্য। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বরখাস্ত আদেশ জারির আধা ঘণ্টার মধ্যে প্যানেল মেয়র চেয়ারে বসে পড়লেন। জনগণের ভোটে মেয়র না হলেও মন্ত্রণালয়ের কৃপায় তিনি যখন দায়িত্ব নিলেন, নিশ্চয়ই ভাবেননি দুই দিনের মাথায় তাঁকে পত্রপাঠ বিদায় নিতে হবে। প্রতিবার যেমনটি হয়। মেয়র মান্নান স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাময়িক বহিষ্কারাদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট রিট করলে আদালত তাঁকে পুনর্বহাল করেন।

এম এ মান্নান গত সোমবার দুপুরে ফের মেয়রের চেয়ারে বসেছেন। কিন্তু কত দিন থাকবেন বলা কঠিন। সরকার হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছে, যার শুনানি হবে ১৩ জুলাই। আদালত নিশ্চয়ই বাদী-বিবাদীর কথা শুনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন।

এম এ মান্নান তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘৬ জুলাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আমি সেই আদেশের বিরুদ্ধে রোববার হাইকোর্টে রিট করেছি। ওই রিটের শুনানিতে আমার অনুকূলে আদেশ পেয়েছি। আমি সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব পালন করার অনুমতি পেয়েছি। হাইকোর্টের রায়ের আলোকে আমি আবার মেয়রের দায়িত্ব পালনের জন্য নগর ভবনে এসেছি। আপনারা দোয়া করবেন। আল্লাহর রহমতে আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারব ইনশাআল্লাহ। সব ক্ষেত্রে আপনাদের সহযোগিতা চাই।’

সরকারপক্ষ কেন এত মরিয়া হয়ে উঠল একজন মেয়রকে পদচ্যুত করতে?

২০১৩ সালের ৬ জুলাই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মান্নান বিজয়ী হন। তাঁর বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে ৩০টি মামলা রয়েছে। সব কটি মামলায় তিনি জামিন পেয়েছেন। মান্নানের স্থানীয় আইনজীবী ও গাজীপুর আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুর মোরশেদ বলেন, মেয়র মান্নান নির্বাচিত হওয়ার পর চার বছরে তিনবার সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন এবং ২২ মাস কারাগারে আটক ছিলেন। দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ১৮ মাস ১৯ দিন।

কেবল সিলেট বা গাজীপুর নয়। সরকারের নির্বাহী আদেশ পদচ্যুত হয়েছেন রাজশাহী ও খুলনার মেয়রও। প্রতিবারই তাঁরা আদালতে রিট করে স্বপদে ফিরে এসেছেন। রেয়াত পেয়েছেন বরিশালের মেয়র আহসান হাবীব কামাল। তিনি বিএনপির নেতা হলেও আওয়ামী লীগের বড় ভাইয়ের সঙ্গে সদ্ভাব থাকার কারণে এখনো বরখাস্ত হননি। কিন্তু আওয়ামী লীগে যাঁদের ‘বড় ভাই’ নেই, তাঁদের মামলা ও বহিষ্কারাদেশের মুখে পড়তে হয়েছে।

২০১৮ সালের মাঝামাঝি এই পাঁচ সিটির নির্বাচন হওয়ার কথা। প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেন লিখেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে ছয় সিটি (উল্লিখিত পাঁচটির সঙ্গে রংপুর) করপোরেশন নির্বাচনে জিতে মানুষকে দলের জনপ্রিয়তা দেখাতে চায় আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছক বা কৌশল চূড়ান্ত করার কথা ভাবছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকেরা।

আওয়ামী লীগ মনে করে, ছয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় নেতা-কর্মীদের ভূমিকা, প্রতিপক্ষের শক্তি ও কৌশল, মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের ভূমিকা বা দক্ষতা এবং নতুন নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। সেই অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কৌশল ঠিক করা হবে।

বিরোধীদলীয় মেয়রদের পদে পদে হেনস্থা করে ছয় সিটিতে ভোট বাড়ানো যাবে কি? বিরোধী দলের সমর্থক মেয়রদের সরাতে মরিয়া কেন সরকার? প্রথমআলো।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক।

Please follow and like us:

Check Also

অনিশ্চয়তার নতুন যুগে মধ্যপ্রাচ্য

ইউক্রেন-রাশিয়া রেশ কাটতে না কাটতেই ফিলিস্তিনের গাজায় শুরু হয় ইসরাইলি আগ্রাসন। এরপর থেকে অশান্ত হতে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।