বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন, নানা প্রতিকূলতা ও অনিশ্চয়তা থেকে টেলিভিশনের নাটকে শিল্পকে রক্ষা করতে পাঁচ দফা দাবি নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করছেন তারা।
‘শিল্পে বাঁচি, শিল্প বাঁচাই’ স্লোগানে বুধবার সকাল ১১টায় রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শুরু হয় এই সমাবেশ।
ফেডারেশন অব টেলিভিশনস প্রফেশলানস অর্গানাইজেশনসের (এফটিপিও) ব্যানারে ‘টেলিভিশন শিল্পী ও কলাকুশলী সমাবেশ’ এর ডাক দেয় তারা।
সমাবেশে তারা পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করে।
শিল্পী-কলাকুশলীদের দাবিগুলোর হলো- ১. দেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বাংলায় ডাবকৃত বিদেশী সিরিয়াল ও অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ করা। ২. টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ ক্রয় ও প্রচারের ক্ষেত্রে এজেন্সির হস্তক্ষেপ ব্যতিত চ্যানেলের অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। ৩. টেলিভিশন শিল্পের সর্বক্ষেত্রে এআইটির নূন্যতম ও যৌক্তিক হার পুনঃনির্ধারণ করতে হবে। ৪. দেশের টেলিভিশন শিল্পে বিদেশী শিল্পী ও কলাকুশলীদের অবৈধভাবে কাজ করা বন্ধ করতে হবে। ৫. ডাউনলিংক চ্যানেলের মাধ্যমে বিদেশী চ্যানেলে দেশীয় বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করতে হবে।
সমাবেশের শুরুতে এফটিপিওর আহ্বায়ক অভিনেতা-নির্দেশক মামুনুর রশীদ স্বাগত ভাষণে বলেন, ‘এই ভূখণ্ডের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ-ভাবনা ও চেতনাকে সুরক্ষিত রাখতেই আমাদের এই আন্দোলন। আমরা আমাদের কিছু দাবি সরকারের কাছে তুলে ধরেছি, আর কিছু দাবি চ্যানেল কর্তৃপক্ষের কাছে। আমরা চাইছি, আমাদের দাবিগুলো শিগগিরই মেনে নেয়া হোক।’
এফটিপিওর সদস্য সচিব নির্মাতা গাজী রাকায়েত এফটিপিওর ধারণাপত্র পাঠ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য একটাই, আমাদের একতার শক্তিটি আমরা দেশবাসীকে দেখাতে চাই। দুর্যোগের মুহূর্তে আমরা একসাথে চলব। তবে আমাদের আন্দোলন কোনোভাবেই সরকারবিরোধী বা চ্যানেলবিরোধী নয়। আমরা সবাই মিলে আমাদের টেলিভিশন মাধ্যমকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, যা হবে এক নতুন উদাহরণ।’
এসময় চ্যানেল মালিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা ব্যবসা করবেন সে ভালো কথা, কিন্তু ব্যবসার পাশাপাশি শিল্পকেও ভালোবাসুন। শিল্প নিয়ে ব্যবসা করবেন তা হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘কেউ আমাদের প্রযোজক-নির্মাতা ও কলাকুশলীদের মধ্যে ভাঙন ধরাতে চাইছে। তাদের উদ্দেশ্য কখনও সফল হবে না।’
চিরতরে হারানো টেলিভিশন নাটকের নির্মাতা, শিল্পী-কলাকুশলীদের উদ্দেশে শোকপ্রস্তাব আনে এফটিপিও, পাঠ করেন অভিনেত্রী সানজিদা প্রীতি।
সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ‘অনেক ক্লায়েন্ট ও এজেন্সি শিল্পী নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্দেশক ও প্রযোজকদের উপর তাদের মতামত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা খুব অমানবিক।’
এটিএম শামসুজ্জামান বলেন, ‘কোনো একটি শক্তি আমাদের ইচ্ছামতো চালাতে চাইছে, দমন করতে চাইছে আমাদের। কিন্তু আমরা তা হতে দেব না। শিল্পী ও কলাকুশলীদের সমস্যার সমাধান করতেই হবে।’
বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে বিদেশী শিল্পী ও কলাকুশলীদের অংশগ্রহণে কর্তৃপক্ষের তুমুল নিন্দা করেন অভিনেতা আবুল হায়াত। বিদেশী শিল্পীরা এ দেশে কাজের ক্ষেত্রে কতটা নীতিমালা মানছে, তাদের কাছ থেকে আদৌ কোনো লভ্যাংশ আসছে কিনা সরকারের প্রতি তিনি তা পর্যবেক্ষণের অনুরোধও করেন।
শুধু টিভিনাটক নয়, সরাসরি গানের অনুষ্ঠানে (লাইভ মিউজিক) বিদেশী শিল্পীদের নিয়ে আসাকেও ভালো চোখে দেখছেন না তিনি। এসব অনুষ্ঠানে প্রায়ই ‘নিম্নমানের বিদেশী’ শিল্পীকে সুযোগ দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন প্রবীণ এ শিল্পী।
টিভি নাটকে ‘বিদেশী আগ্রাসনের’ ব্পিরীতে ‘অবহেলিত’ বাংলাদেশ টেলিভিশনকে সক্রিয় করে তোলার আহ্বান জানান আবুল হায়াত।
তিনি বলেন, ‘এখন বিটিভিকে নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের। বিটিভি ওয়ার্ল্ডে আমাদের নাটকগুলো সঠিকভাবে প্রচার করতে হবে।’
টিভিনাটকে পারিশ্রমিক ইস্যুতে ‘তারতম্য’ সমস্যা সমাধানে প্রযোজকদের প্রতি অনুরোধ জানান নাট্যব্যক্তিত্ব ইনামুল হক।
তিনি বলেন, ‘এখানে এসে সবাইকে আসল কথাটি বলতে হবে। হিপোক্রেসি নিয়ে আন্দোলন হবে না। আত্মসমালোচনাও করা উচিত। অনেক প্রোডাকশন হাউজও শিল্পীদের সঙ্গে নানা সমস্যা তৈরি করে। তাদের শোধরাতে হবে।’
নির্মাতা বৃন্দাবন দাস বলেন, ‘আজকের এই সংকট আমাদের পেশার, সংস্কৃতিরও। আমাদের পরিচয়হীন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের আজকের এই আন্দোলন।’
অভিনেত্রী ডলি জহুর বললেন, ‘এই আন্দোলনের সঙ্গে দর্শকদের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।’
আন্দোলনে সংহতি জানাতে এসেছিলেন জাহিদ হাসান, রোকেয়া প্রাচী, অরুণা বিশ্বাস, চঞ্চল চৌধুরী, আনজাম মাসুদ, সাজু খাদেম, জাকিয়া বারী মম, শিহাব শাহীন, জিয়াউল ফারুক অপূর্ব, ফারহানা মিলি, আজমেরি হক বাঁধন, মৌসুমী হামিদ, রুনা খান, তানজিকা আমিন, কল্যাণ কোরাইয়া, দোলন দে, ফারজানা চুমকি, শামীমা তুষ্টি, রওনক হাসানসহ একাল-সেকালের অভিনেতা, নির্মাতা ও কলাকুলশীরা।
ফেডারেশনস অব টেলিভিশনস প্রফেশনালস অর্গানাইজেশনের অন্তর্ভুক্ত ডিরেক্টরস গিল্ড, টেলিভিশন নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার সংসদ, অভিনয় শিল্পী সংঘ, অডিও ভিজ্যুয়াল টেকনিক্যাল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, টেলিভিশন মেকআপ আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, শুটিং হাউজ অব বাংলাদেশ, টেলিভিশন নাট্যকার সংঘ ছাড়াও বাংলাদেশ নাট্যাঙ্গন থিয়েটার বুধবারের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছে।