‘মা-ই ওরে এতিম করল’

ক্রাইমবার্তা রিপোট: হাসপাতালের বিছানায় শোয়া নাতনিকে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না শাহে আলম চৌকিদার। মায়ের বিস্ফোরিত বোমায় তার খাদ্যনালির বিভিন্ন অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। গালে-ঠোঁটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে স্প্লিন্টারের আঘাতের চিহ্ন। কথা বলে না। থেমে থেমে শুধু আকুল হয়ে কাঁদে মায়ের জন্য।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালেই পুলিশ শাহে আলম চৌকিদারকে নিয়ে গিয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে। আশকোনার সূর্য ভিলায় আত্মঘাতী শাকিরা তাঁর মেয়ে কি না শনাক্ত করতে গত বুধবার ভোলার চরফ্যাশন থেকে এসেছেন তিনি। মেয়েকে শনাক্ত করার পর শাহে আলম চৌকিদার পুলিশের সঙ্গেই নাতনির কাছে গিয়েছিলেন। শিশুটিকে তখন স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ড্রেসিং করাতে। শিশুটির কাছে আপনজন বলতে শুধু তাকে ঘিরে থাকা পুলিশ, হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স আর আয়া। মা-বাবা-ভাই-বোন-আত্মীয়স্বজন কেউ কাছে নেই। ঢাকার আশকোনার জঙ্গি আস্তানা থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার শিশু সাবিনা এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন l ফাইল ছবি
ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে বেরোনোর পর শাহে আলম চৌকিদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মা-ই ওরে এতিম করল। আল্লাহ ছাড়া আর কে থাকল ওর? নাতনিরে দেইখা আর মন মানাইতে পারতেছি না। তার প্রতি ঘিন্না ছাড়া আর কিচ্ছু নাই। এত্তটুকু বাচ্চারে কলঙ্ক দিয়া গেল। যেইখানে যাইব লোকে মনে করাইয়া দিব যে ওর মা কী ছিল। স্কুল-কলেজ-বিয়া সব সময় এই কলঙ্ক থাকব। কে দেখব ওরে? কে?’
শাহে আলম আরও বলেন, শিশুটির বাবা ইকবাল আগেই মারা গেছেন। ভোলার লালমোহনে শিশুটির চাচারা আছেন। কিন্তু তাঁদের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। তাঁর নিজের অবস্থাও ভালো নয়। মেয়ের কৃতকর্মের জন্য তিনি নিজেই একঘরে হয়ে আছেন। শিশুটি তাঁর কাছে গিয়ে ভালোভাবে বড় হয়ে উঠতে পারবে কি না, সেই শঙ্কাও আছে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি।
বোমায় আহত শিশুটি হয়তো এখনো এত কিছু বোঝে না। গতকাল ঘণ্টা দুয়েক ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডের সামনে বসে থেকে শিশুটিকে দেখার সুযোগ হয়। তাকে ঘিরে আছেন নারী পুলিশদের একটি দল। পুলিশের কিনে দেওয়া নতুন জামা এখন শিশুটির পরনে। যন্ত্রণায় মলিন মুখ। চোখে শূন্য দৃষ্টি। ছোট্ট হাতে স্যালাইনের সুই গোঁজা। ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে দায়িত্বরত এক আনসার সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটি প্রায়ই ভয় পায়। নিজে থেকে কিছু বলে না। মা মা বলে ডাকে শুধু।
গতকাল দুপুরের দিকে হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে শিশুটি। সঙ্গে সঙ্গে নার্স ও নারী পুলিশেরা এগিয়ে আসেন। জানতে চান সে কী চায়। শিশুটি জানায় তার খিদে পাচ্ছে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত পানি ছাড়া মুখে কিছু খাওয়ানো চিকিৎসকের নিষেধ ছিল। বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাকে অল্প সময়ের জন্য তাঁরা থামান। সন্ধ্যার দিকে ঘুম থেকে উঠে সে আবার কাঁদতে শুরু করে। একই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এক শিশুর স্বজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাচ্চাটা মায়ের জন্য এমন করে কাঁদছিল! শুধু বলে আমার আম্মুকে এনে দাও। এখনই এনে দাও। চিকিৎসক, নার্স, পুলিশও তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। কিছুতেই তাকে থামানো যাচ্ছিল না। একসময় কাঁদতে কাঁদতে একাই সে ঘুমিয়ে পড়ে।’
আশকোনার সূর্য ভিলায় পুলিশি অভিযান শুরুর ১২ ঘণ্টা পর শাকিরা তাঁর ছোট্ট মেয়েটির হাত ধরে বেরিয়ে আসেন। ছবিতে দেখা যায় ভয়ার্ত শিশু তার মায়ের বোরকার একটি কোণা খামচে ধরে বেরিয়ে আসছে। পুলিশ জানায়, মেয়েকে কয়েক পা এগিয়ে দিয়ে কোমরে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটান শাকিরা। বিস্ফোরণে শিশুটির নাড়িভুঁড়ির কিছুটা অংশ বেরিয়ে যায়। হাত-পা-মাথায় তীব্র আঘাত লাগে। প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা অস্ত্রোপচার করে ছিঁড়ে যাওয়া খাদ্যনালি জোড়া লাগান চিকিৎসকেরা। খাদ্যনালির কিছু কিছু জায়গা কেটে বাদ দিতে হয়। এখনো শিশুটির শরীরে বেশ কিছু স্প্লিন্টার রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক খাজা আবদুল গফুর।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘শিশুটিকে আমরা তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করতে চাই। ওর নানা ও মামা এসেছেন। যদি তাঁরা দায়িত্ব নিতে না চান, তাহলে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে প্রাথমিকভাবে নেওয়া হবে।’

Check Also

ঘোনা ইউনিয়নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন

আবুল হোসেন সদর প্রতিনিধি : ঘোনা ইউনিয়নে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।