ক্রাইমবার্তা রিপোট: নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার তোলা ১৩ দফা প্রস্তাব আর আলোচনায় নেই।
এপ্রসঙ্গে বিএনপি বলছে ‘বিএনপি কখনোই বলেনি ১৩ দফাই মানতে হবে। এরথেকেও ভালো প্রস্তাব আসলে রাষ্ট্রপতি তা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।’
রাষ্ট্রপতির সংলাপ শেষে এখন পাঁচ বছর আগের মতোই সার্চ কমিটি গঠন করে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের কথা শোনা যাচ্ছে। এই অবস্থায় নিজেদের তোলা প্রস্তাবের বদলে সার্চ কমিটিতে নিরপেক্ষ লোকদের নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন খোদ বিএনপি নেতারা।
২০১২ সালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন গঠনের আগেও সে সময়ের রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথা বলেছেন। তখনো বিএনপি যোগ দিয়েছিল বঙ্গভবনের সংলাপে। এরপর সার্চ কমিটি গঠন করে তাদের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।
আগামী মাসের শুরুতেই শেষ হচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। তার আগে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন নতুন কমিশনকে। এই কমিশনের অধীনেই হবে আগামী সংসদ নির্বাচন। তাই কমিশনে কে আসছে-এ নিয়ে বিশেষ করে বিএনপি চিন্তিত।
নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে গত ১৮ নভেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসন সংবাদ সম্মেলন করে ১৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর মূল কথা ছিল, সব দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ। যতক্ষণ এই মতৈক্য প্রতিষ্ঠা না হবে ততক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে আলোচনা।
এই প্রস্তাব উত্থাপনের ঠিক এক মাস পর গত ১৮ ডিসেম্বর বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। তাকে ওই আলোচনাতে খালেদা জিয়ার তোলা ১৩ দফার সংক্ষিপ্তরূপ তুলে দেয় বিএনপি।
এর পরের এক মাসে রাষ্ট্রপতি কথা বলেছেন আরও ৩০টি দলের সঙ্গে। তিনি নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দিতে পাঁচ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করতে যাচ্ছেন বলে বঙ্গভবনের সূত্র দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা ইউএনবি। অর্থাৎ খালেদা জিয়ার দেয়া ১৩ দফা বিবেচনায় নেই।
শুরুতে দলীয় প্রধানের ঘোষিত ১৩ দফাকে আমলে নিয়ে নির্বাচন কমিশন বাছাই করার কথা বললেও এখন এ নিয়ে সরব নন বিএনপি নেতারাও। এখন তারা বলছেন,সার্চ কমিটি যেন নিরপেক্ষ হয়।
তাহলে বিএনপি কি ১৩ দফা থেকে নিজেই সরে এসেছে?- দলটির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা বলেছে গণমাধ্যম। তারা বলছেন, তাদের চেয়ারপারসনের প্রস্তাব হুবহু মানতে হবে তা নয়। এর থেকেও ভালো প্রস্তাব আসলে সে আলোকে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হোক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিএনপি কখনোই বলেনি ১৩ দফাই মানতে হবে। এরথেকেও ভালো প্রস্তাব আসলে রাষ্ট্রপতি তা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। সেই আশা নিয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপেও একই কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিএনপিসহ অন্যান্য দলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অতীতের ন্যায় দলীয় লোক দিয়ে সার্চ কমিটি করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে অনাকাঙ্খিত।’
খালেদার ১৩ দফায় কী ছিল?
বিএনপি চেয়ারপারসনের দেয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছিলো- নতুন কমিশন নিয়োগ দেওয়ার আগে সব দলের ঐক্যমতে রাষ্ট্রপতি একটি বাছাই কমিটি গঠন করবেন। এবং সব দল বাছাই কমিটির কাছে নাম দেবে। যে নামগুলো সব দল থেকেই এসেছে, সেখান থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) পদে দুজন ও প্রত্যেক নির্বাচন কমিশনারের বিপরীতে দুজনের নাম চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে কমিটি। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও ইসি নিয়োগ করবেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর দেয়া নামের প্রস্তাবে মিল না পাওয়া পর্যন্ত বাছাই কমিটি দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথাও বলা হয়েছিলো।
প্রস্তাবে বলা হয়েছিলো, বাছাই কমিটি সিইসি ও ইসি নিয়োগের জন্য দলগুলো থেকে পাওয়া ব্যক্তিদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। কমিটি সেখান থেকে সিইসি পদে দুজন ও ইসি পদে আটজনের নাম বাছাই করবে।
বিএনপি প্রধানের পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠনের প্রক্রিয়াও বলা হয়েছিলো। অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মক্ষম একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, যিনি বিতর্কিত নন এবং অবসর গ্রহণের পর সরকারের কোনো লাভজনক পদে ছিলেন না এমন সদস্যকে আহ্বায়ক করার প্রস্তাব করা হয়েছিলো।
রাষ্ট্রপতির সংলাপ শেষে বঙ্গভবনের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা
গত ১৮ ডিসেম্বর শুরু হওয়া সংলাপ শেষ হয় ঠিক এক মাস পর। এই সময়ে রাষ্ট্রপতি কথা বলেছেন মোট ৩১টি দলের সঙ্গে। তাদের সবাই আলাদা আলাদা প্রস্তাব দিয়েছেন তাকে।
বঙ্গভবন থেকে জানানো হয়েছে সব দলের দেওয়া মতামত ও প্রস্তাব বিবেচনা করে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব হবে বলে আশা করছেন রাষ্ট্রপতি।
আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত না আসলেও জানা গেছে, বর্তমান কমিশন নিয়োগের মতোই সার্চ কমিটির মাধ্যমে নতুন কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সার্চ কমিটি পাঁচ সদস্যের গঠিত সার্চ কমিটি সুপারিশের ভিত্তিতেই নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনারদের (ইসি) নাম ঘোষণা করবেন রাষ্ট্রপতি।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আহমদ আযম খান বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট। ১৩ দফা বা অন্য কোনো দলের ভালো প্রস্তাবগুলো থেকে নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হোক। তা না করে দলীয় লোক দিয়ে পাঁচ জনের নির্বাচন কমিশন গঠন করলে জনগণও মানবে না, বিএনপিও মানবে না।’
রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘এখনও সময় আছে। আশা করি রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে প্রয়োজনবোধ করবেন। সংলাপের আলোকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন।’
বিএনপি কি ১৩ দফা ছেড়েছে?
খালেদা জিয়া ১৩ দফা প্রস্তাব দেয়ার পরপরই আওয়ামী লীগ তা প্রত্যাখ্যান করে। এরপর বিএনপি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে এই প্রস্তাব দিতে অনেক চেষ্টা করেছে। পরের মাসের শুরুর দিকে দলের একটি প্রতিনিধি দল তা বঙ্গভবনে পৌছে দেয়।
কিন্তু এখন আর সেই ১৩ দফা নিয়ে কিছুই বলছে না বিএনপি। রাষ্ট্রপতির সংলাপ শেষ হওয়ার পর বৃহস্পতিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন,‘এখন আমরা আশা করব রাষ্ট্রপতি সত্যিকার অর্থে একটি নিরপেক্ষ সার্চ কমিটির মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন যা সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য যোগ্য হবে।’
বুধবার দলের প্রতিষ্ঠাতার জন্মবার্ষিকীর আলোচনায় যোগ দিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি লোক দেখানোর জন্য আলোচনা করছে। নির্বাচন কমিশনের কাদের নিয়োগ দেওয়া হবে তা দুই বছর আগেই আওয়ামী লীগ ঠিক করে রেখেছে। সার্চ কমিটির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা নিয়োগ পেলে মানবো না।’
একই অনুষ্ঠানে দলটির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে কথা বললেও কেউই চেয়ারপারসনের ১৩ দফার কোনো কথা উল্লেখই করেননি।
বিএনপি কি তাহলে ১৩ দফা প্রস্তাব থেকে সরে এসেছে?- এমন প্রশ্নে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছি, আশাবাদীও হয়েছি। আমরা শেষ পর্যন্ত এই আশায় থাকতে চাই যে, অতীতের মতো পদলেহী, পক্ষপাততুষ্ট নয়, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার মতো কমিশন গঠন করবেন।এখানে ১৩ দফার পক্ষে থাকা না থাকা কোনা বিষয় বলে আমি মনে করি না।’