ক্রাইমবার্তা রিপোট:‘নাগরিকত্ব আইন-২০১৬ খসড়া’ প্রসঙ্গে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, ক্ষমতাসীন দলের একটি বিশেষ পরিবার ও কিছু ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্যই সরকার এই আইন প্রণয়ন করছে। তাই সংসদে পাশ হওয়ার আগে এই খসড়া আইনটি জনগণের কাছে তুলে ধরে, আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময়ের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। তাহলে আইনটিকে আরো পরিশুদ্ধ ও অনেক উন্নতমানের করা যাবে বলে বক্তারা মত দেন। আজ শুক্রবার বিকেলে এক ‘নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তারা একথা বলেন।
রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে বিএনপির উদ্যোগে বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন-২০১৬ খসড়া নিয়ে এই আলোচনা সভা হয়। বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামালের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় অন্যান্যের মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, শওকত মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মাইনুল আহসান খান, অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান, সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
খসড়া আইনের ওপর মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন- দলের ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া, ফাহিমা নাসরিন মুন্নী, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
এই নাগরিক ভাবনার আলোচনায় বিএনপির সিনিয়র ও কেন্দ্রীয় নেতা নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, আবদুল মান্নান, গিয়াস কাদের চৌধুরী, আহমেদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, গোলাম আকবর খন্দকার, আবদুল হালিম, কাজী মাজহারুল আনোয়ার, ইসমাইল জবিহউল্লাহ, সুজাউদ্দিন, খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, শামা ওবায়েদ, অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যাপক আবদুল মান্নান মিয়া, আশরাফ উদ্দিন উজ্জ্বল, হেলাল খান, শিরিন, নূরুল ইসলাম নয়ন, শায়রুল কবির খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, এই আইনের উদ্দেশ্য কী? অনেকে আলোচনা করেছেন, তাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে যেটা বুঝি, এই আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদের ক্ষমতাকে আরো বেশি সংহত করা, শাসক গোষ্ঠীর নিরাপত্তা প্রদান করা। অনেকে আলোচনা করেছেন, কোনো একটি নির্দিষ্ট পরিবার বা কিছু ব্যক্তি বা শাসকগোষ্ঠির কিছু মানুষকে শুধুমাত্র প্রটেকশন দেয়ার জন্যই এই আইন করা হচ্ছে। এটা পরিষ্কার যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সুপরিকল্পিতভাবে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করতে যাচ্ছে। সেখানে অন্য কোনো মত, অন্য কোনো পথ থাকবে না। তাদের চিন্তার মানুষগুলোই থাকবে- সেই লক্ষ্যে তারা একটার পর একটা আইন করে চলেছে। সরকারের এরকম আইনের খসড়ার বিরুদ্ধে সারাদেশে জনমত গড়ে তোলার আহবান তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, এই সরকারের চরিত্রটা কী? তারা চরিত্র একটিই যেকোনো উপায়ে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায় এবং ক্ষমতাকে টিকে থাকার জন্যেই গণতন্ত্রের সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। দেখেন- সংসদকে একটা রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত করেছে। এখানে কোনো জনপ্রতিনিধিত্ব নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে সব প্রতিষ্ঠান তারা দখলে নিয়েছে। দেশে কোনো আইনের শাসন নেই। মিডিয়াও তারা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এই সরকারের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে দেশকে বিভক্ত করে, সমাজ ও জনগণকে বিভক্ত করে ক্ষমতায় টিকে থাকা। সেজন্য তারা একের পর এক আইন হচ্ছে।
নাগরিকত্ব আইনের খসড়ায় প্রবাসীদের বিষয়ে প্রস্তাবনার সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল বলেন, এই খসড়ায় প্রবাসীদের কথা বলা হয়েছে যে, তারা দেশে ফিরে আসলে ছয় বছরের আগে কোনো রাজনৈতিক দল করতে পারবে না, কোনো সংগঠন করতে পারবে না এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পর্যন্ত অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এরকম একটা অদ্ভুত আইন এটি। মানুষের অধিকার হরণের এই রকমের আইন হতে পারে না- এটা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে যে ব্যবহার করা হয়েছে সে প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, যেখানে দেশনেত্রী বলছেন, এই আদালতের প্রতি আমার কোনো আস্থা নেই, সেখানে জোর করে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিভাবে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের সাজা দেয়া যায়, সেজন্য একটার পর একটা মামলা দেয়া হচ্ছে। একটা মামলাকে দুইটা ভাগ করা হচ্ছে। সেটার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করা হচ্ছে। রাজশাহী বিভাগ- রাজশাহীতে নিয়ে যাচ্ছে, চট্টগ্রাম বিভাগের মামলা চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এভাবে যতরকমের নির্যাতনমূলক, নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার, এই সরকার তা করছে।
দেশের মৌলিক অধিকার হরণ করছে সরকার অভিযোগ করে তিনি বলেন, নাগরিকত্ব আমার মৌলিক অধিকার। এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও প্রাকৃতিক অধিকার। যেখানে আমি জন্মগ্রহণ করবো, সেখানে আমার নাগরিকত্ব থাকবে। আজকে মানুষকে নাগরিকত্বহীন করা হচ্ছে।
সরকার যে নাগরিকত্ব হরণ করবার নীল নকশা নিয়ে এগুচ্ছে, আমাদের স্বাধীনতার অর্জনকে বিনষ্ট করছে, তাকে রুখে দাঁড়ানোর একমাত্র পথ হচ্ছে জনগনকে সংগঠিত করে এই সরকারকে বাধ্য করা একটি নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে দেশে একটি সুষ্ঠু গ্রহনযোগ্য নির্বাচন করা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, আইনটির খসড়া দেখে মনে হচ্ছে এটি হয় অপরিপক্কতা না হয় অমনোযোগিতায় করা হয়েছে। তা নাহলে এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে। তাদের মাইন্ডসেটে কি আছে, কি উদ্দেশ্যে করেছেন, তা তো আমরা জানি না। এটা কী অমিশন, এটা কী ছেলে-খেলা? আমি বলব- যেহেতু এই বিলটি এখনো সংসদে উঠে নাই। তাই সরকারের একটা সুযোগ আছে, এটাকে জনগণের কাছে তুলে ধরা, আলাপ-আলোচনা করা ও মতবিনিময় করা। তখন দেখা যাবে আইন করতে হয়, তবে আইনটিকে আরো পরিশুদ্ধ ও অনেক উন্নতমানের করা যাবে।
আইনের খসড়াটি ‘নেতিবাচক’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, এটা জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী একটি বিল। এটা আমাদের উচিৎ হবে আরো বেশি জনসমক্ষে নিয়ে আসা।
অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এই সংসদের কোনো জনপ্রনিধিত্ব নেই। এই সংসদে যদি কোনো আইন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হলে এটি তা উচ্চ আদালতে টিকবে না। তবে আমি বলতে চাই, এই সেমিনার কিংবা আলোচনা সভার মাধ্যমে অবৈধ সরকারের আইন ঠেকানো যাবে না। এর ফয়সালা হয় আদালত না রাজপথেই করতে হবে।
শওকত মাহমুদ বলেন, এই আইনটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, একটি পরিবারের অনেক বিদেশী নাগরিক সদস্য রয়ে গেছেন, তাদের হয়ত নাগরিক বানাতে হবে। এমন অনেক নাগরিক আছেন, যাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করতে হবে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণেই। এটি হচ্ছে এই নাগরিকত্ব আইন-২০১৬ এর মূল স্পিরিট। এরকম আইন অমানবিক আইনের খসড়া, আন্তর্জাতিক সনদেরও পরিপন্থী। এটা কোনো নির্বাচিত সংসদ এ ধরণের আইন করতে পারে না।