আমার চেয়ে বেশি নির্যাতন কাউকে করা হয়নি

ক্রাইমবার্তা রিপোট: দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।

দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছেন, ‘বাংলাদেশে আমি সবচাইতে অধিকার বঞ্চিত একজন নাগরিক। বাংলাদেশে আমার থেকে বেশি নির্যাতন কাউকে এভাবে করা হয়নি, যেভাবে আমাকে করা হয়েছে।’

আজ মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনী মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদুর এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনের পর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এই সম্মেলনের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও পাঠানো হয়েছে।

মাহামুদুর রহমান দাবি করেন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তাঁর চিকিৎসার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর কারাভোগের কারণে তিনি গুরুতর অসুস্থ। বিদেশে চিকিৎসার প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।

গত ২৩ নভেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর এটাই সংবাদ মাধ্যমে তাঁর প্রথম আনুষ্ঠানিক বক্তব্য। সংবাদ সম্মেলনে কবি ফরহাদ মজহার, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক রুহুল আমিন গাজী, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি শওকত মাহমুদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, আমার দেশ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদসহ সংবাদকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে নিজের নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে দাবি করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করা নাগরিক অধিকার। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী আমার সেই নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে। সংবিধানের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯ এবং ৪০-এ পাঁচটি মৌলিক অধিকার আমার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কেড়ে নিয়েছে। বাংলাদেশে আমার থেকে বেশি নির্যাতন কাউকে এভাবে করা হয়নি, যেভাবে আমাকে করা হয়েছে।’

যুক্তরাজ্যের ভিসা আবেদন খারিজের ব্যাপারে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের ভিসা কর্মকর্তা আমার ভিসা খারিজ করার হাস্যকর কারণ দেখিয়েছেন। তিনি সেখানে বলেছেন, আমি নাকি যুক্তরাজ্যে গেলে নাও ফিরতে পারি। রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারি। কিন্তু আমার বয়স এখন ৬৩ বছর। যুক্তরাজ্যে থাকার চিন্তা আমি কখনোই করিনি এবং ভবিষ্যতেও করব না। ১৯৮৬ সালে আমি প্রথম যুক্তরাজ্যে যাই। এরপর থেকে প্রতিবারই পাঁচ বছরের জন্য আমার ভিসা নবায়ন করা হয়। সর্বশেষ ২০১২ সালে আমার চোয়ালের অপারেশনের জন্য লন্ডনে গিয়েছিলাম। তখনো আমার ওপর সরকারি দমন-পীড়ন চলছিল এবং আমি ৫০টি মামলার ভিকটিম ছিলাম। সে সময়ও লন্ডনে থেকে যাওয়ার কোনো চিন্তা আমার মাথায় আসেনি এবং অপারেশনের জন্য যে কয়দিন থাকা দরকার সেই কয়দিনই আমি সেখানে ছিলাম। আমার মনে হয় যুক্তরাজ্যের দৃষ্টিতে আমার অপরাধ আমি কেন ইসলামের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি? আজ আমি যদি ইসলামের বিরুদ্ধের শক্তি হতাম, তাহলে আমাকে ভিসা চাইতে হতো না, ডেকে নিয়ে ভিসা দেওয়া হতো।’

মাহামুদুর রহমান আরো বলেন, ‘আপনারা ইতিমধ্যেই জানেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাতটি মুসলমান দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা প্রদানে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম সেখানে সফরে গিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে, সেহেতু যতটুকু চিকিৎসা করা সম্ভব দেশেই করাব, বাকিটা মহান আল্লাহর ইচ্ছা।’

মুক্তির পর দুই মাসেরও বেশি সময় কোনো বক্তব্য না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে মাহমুদুর বলেন, ‘গত ২৩ নভেম্বর কাশিমপুরের ছোট কারাগার থেকে এখন আমি বাংলাদেশ নামের বড় কারাগারে। বর্তমান সরকারের আট বছরের মধ্যে পাঁচ বছরই কারাবন্দি ছিলাম। প্রথম দফায় ১০ মাস এবং দ্বিতীয় দফায় একটানা প্রায় চার বছর। এত দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকার ফলে আমি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হই। মেরুদণ্ড, ঘাড়, হাত ও কোমরের হাড়ের ক্ষয় রোগে আমি বিপর্যস্ত। তাই জেল থেকে বেরিয়েই ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হই।’

আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বলেন, ‘এ হাসপাতাল (ইউনাইটেড হাসপাতাল) ও পিজির চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দেন। জামিন পাওয়ার পর আমার পাসপোর্ট আদালতে আটকে রাখা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মেডিকেল রিপোর্টসহ বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ চেয়ে পাসপোর্ট ফেরতের আবেদন জানালে মহামান্য আপিল বিভাগ আমাকে পরীক্ষা করার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠনের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী মেডিকেল বোর্ড আমাকে পরীক্ষা করে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে আরো উন্নত চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসার সুপারিশ করেন। এ সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য আপিল বিভাগ চারটি শর্তে আমাকে শুধু যুক্তরাজ্যে যাওয়ার অনুমতি দেন। এতে বলা হয়- ইউকেতে (যুক্তরাজ্য) আমি ৩০ দিন থাকতে পারব, সেখানে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারব না, ফিরে এসে পাসপোর্ট জমা দিতে হবে এবং মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পাসপোর্ট ফেরত পাব না।’

মাহামুদুর রহমান বলেন, “‘মুসলমানের মানবাধিকার থাকতে নেই’ নামে আমার একটি বই আছে। এখনো বইটি বিক্রি হয়। যুক্তরাজ্যে আমার ভিসা খারিজ এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একের পর এক সিদ্ধান্তে সেটাই আজ প্রমাণিত হচ্ছে।”

নিজের লেখালেখি ও দৈনিক আমার দেশ প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘গত ১ ফেব্রুয়ারি সিএমএম আদালতে আমি আমার দেশের প্রেস খুলে দেওয়ার আবেদন জানিয়েছি। আমার বিশ্বাস আদালত আমার আবেদন আমলে নিয়ে আমার দেশের প্রেস খুলে দেবেন। আমার দেশ আবারও ছাপার অক্ষরে আসবে। শত শত বেকার সাংবাদিক আবারও কর্মস্থল ফিরে পাবে। আর লেখালেখি আমার বন্ধ হয়নি, লেখালেখি চলছে। জেলের মধ্যেও আমি লিখেছি এবং এখনো লিখছি। কিন্তু এই লেখা ছাপার জায়গা আজ নেই। আমার বিশ্বাস কোনো একদিন এই লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছাবেই।’

দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী শাসনে দেশের মানুষ দিশেহারা। যে আদর্শ নিয়ে ২০১৩ সালে আমি জেলে গিয়েছিলাম, সেই আদর্শ এখনো আমি লালন করি। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা এবং দেশ ও জনগণের স্বার্থের পক্ষে আমার সংগ্রাম চলবে।’ গণমাধ্যমের পরিস্থিতির কথা বলে তিনি দুঃখ করে বলেন, “২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৫ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, ৮৮৬ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন, ২০০ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৬ জন সাংবাদিককে। আর আমার বিরুদ্ধে ৮১টি মামলা তো সবারই জানা। এই হলো ‘স্বাধীন’ সাংবাদিকতার চিত্র।”

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।