ক্রাইমবার্তা রিপোট: : রাউধা আথিফরাজশাহীতে ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী, মালদ্বীপের নাগরিক ও মডেল রাউধা আথিফের মৃত্যুর কারণ নিয়ে রহস্য ঘণীভূত হতে শুরু করেছে। রাউধার বাবার দাবি, তার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। মেয়ের লাশ ও মৃত্যু যেখানে হয়েছে, সেই ঘটনাস্থল দেখে তার এই সন্দেহ আরও জোরালো হয়েছে। আর রাজশাহীর পুলিশ বলছে, হত্যা ও আত্মহত্যা এই দুটি কারণকে ‘ফিফটি-ফিফটি’ বিবেচনায় তারা তদন্ত চালাচ্ছেন। এদিকে রাজশাহীতে উপস্থিত মালদ্বীপের দুই পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘তদন্ত’ নয়, বরং তারা পরিস্থিতি বুঝতে এসেছেন।
মালদ্বীপের দুই পুলিশ কর্মকর্তা মঙ্গলবার রাজশাহী পর্যটন মোটলে রাউধার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছেন। মেয়ের দাফনের পর চলে যাওয়ার কথা থাকলেও রাউধার স্বজনরা তদন্তে সহায়তার জন্য এখনও রাজশাহীতেই আছেন।
রাউধার বাবা মোহাম্মাদ আথিফ মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ‘আমার মেয়ে আত্মহত্যা করতে পারে না। তাকে হত্যা করা হয়েছে। লাশ দেখার সময়ও আমার এরকম মনে হয়েছে। তাকে গলাটিপে হত্যা করে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলানো হয়েছে। এমনকি তার ঘরের দরজা খোলার জন্য কোনও ভাঙা অংশও পাওয়া যায়নি। ধাক্কা দিলে তো দরজার ছিটকানি ভেঙে যাবে। সেটাও ঠিক রয়েছে। আবার রাতের খাওয়ার জন্য সে রান্নাও করেছে। তার মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে, তখন সে কয়েকদিনের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা বলেছে। তাহলে সে কেন আত্মহত্যা করবে। সে মানসিকভাবে খুবই শক্ত প্রকৃতির মেয়ে। তার চলাফেরা এখানকার পরিবেশের সঙ্গে মিলতো না। এই কারণে সে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারতো না। আমাদের আবেদনের কারণে মালদ্বীপের পুলিশ এখানে এই ঘটনাটি উদঘাটন করার জন্য এসেছেন।’
এদিকে মালদ্বীপের দুই পুলিশ কর্মকর্তা মঙ্গলবার ইসলামী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী হোস্টেলের ২০৯ নম্বর রুমটি পরিদর্শন করেন। এসময় তারা রুমের দরজাটি বেশ কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে দেখেন। সেই সঙ্গে রুমের ভেতরের জানালাসহ তার ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। একই সঙ্গে তারা রাউধার মৃত্যুর তদন্ত সংশ্লিষ্ট রাজশাহী মহানগর পুলিশ কর্মকর্তা, মেডিক্যাল কলেজের কর্মকর্তা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এসময় মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক রাশেদুল হকসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তবে এ বিষয়ে মিডিয়ার সঙ্গে কোনও কথা বলতে রাজি হননি মালদ্বীপের দুই পুলিশ কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে রাজশাহী নগরীর শাহ মখদুম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জিল্লুর রহমান বলেন, ‘‘বাইরের দেশের লোক এসেছে। সেই সঙ্গে আমার থানা এলাকার মধ্যে ঘটনাস্থল। তাই তাদের সহযোগিতা করছি। তবে মালদ্বীপের পুলিশের কাছে আমরা বার বার জানতে চেয়েছি ‘আপনারা তদন্ত করতে এসেছেন কিনা?’ এই বিষয়ে তারা বলেছেন ‘না, আমরা কোনও তদন্ত করতে আসেনি। এখানে মালদ্বীপের আরও কজন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। তাই শিক্ষার্থীরা যাতে ভয়ভীতি ছাড়া পড়াশোনা করতে পারেন, সে বিষয়টি দেখার জন্য এসেছি।’ তবে তারা (মালদ্বীপের পুলিশ) এই ঘটনাটির প্রকৃত রহস্য তাড়াতাড়ি উদঘাটনের জন্য আমাদের বলেছে। সে কেন আত্মহত্যা করলো? আর এলাকাটির আইডিয়া নেওয়ার জন্য তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করছেন।’’
ওসি জিল্লুর রহমান আরও জানান, ‘মেয়েটি কেন সিঙ্গেল রুমে থাকতো এই কথা জানতে চেয়েছে মালদ্বীপের পুলিশ। তাদের বলেছি, মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে জানিয়েছেন, সে রুমে একা থাকতে পছন্দ করতো। কারণ তার অন্যদের সঙ্গে ঘুমাতে অসুবিধা হতো। নিজের রুমের অন্যদের চেয়ে জিনিসপত্র বেশি। কারণ সে আরামদায়কভাবে থাকতে পছন্দ করতো।’
তিনি আরও জানান, ‘তারা বাইরের দেশের মেহমান, এখানে এসেছেন। তাদের নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের কর্তব্য। আর তারা কতদিন এখানে থাকবেন, তা আমি বলতে পারবো না। আমরা তাদের আমন্ত্রণ করিনি। মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ তাদের চলাচলের জন্য গাড়ি দিয়েছেন। বিষয়টি মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষের ব্যাপার।’
এদিকে রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজের সেক্রেটারি আব্দুল আজিজ রিয়াদ বলেন, ‘এখানে মালদ্বীপের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেন। তাদের জন্যই দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছে সে দেশের সরকার। এখানে এসে তারা আমাদের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, নিরাপত্তাকর্মীসহ যাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথা বলেছেন। মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ থেকে তাদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য গাড়ি ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে। এখানে অন্য কোনও খারাপ উদ্দেশ্য নেই।’
রাউধার মৃত্যু তদন্ত নিয়ে রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার আল আমিন হোসাইন বলেন, ‘আমরা এই ঘটনাটি ফিফটি-ফিফটি দৃষ্টি রেখে তদন্ত করছি। আত্মহত্যা না হত্যা করা হয়েছে- সেই বিষয়টি মাথায় রেখে তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তার আইফোনটি লক আছে। এখানে খোলা যাচ্ছে না। তাই আইফোন লক খোলা ও ল্যাপটপ দেখার জন্য ঢাকায় সিআইডি অফিসে পাঠানো হবে। তার বাবা-মা এখানে আছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু এখনও কোনও লিখিত জবানবন্দি নেওয়া হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তার (রাউধার) পারিবারিক বিষয়, প্রেমিকের সঙ্গে বিচ্ছেদ, বন্ধুদের সঙ্গে কোনও বিরোধ আছে কিনা, এসব বিষয় দেখা হচ্ছে। এমনকি হোস্টেলের ভেতরে কারা যাওয়ার অনুমতি পায়, কিংবা হোস্টেল ও মেডিক্যাল ক্যাম্পাসের ভেতরে যাতায়াত করতে পারে, সেগুলোও জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। রাউধার বই, খাতা, ডায়েরিতে এমন কোনও বিষয় লেখা ছিল কিনা, যা মানসিকভাবে তাকে বিপর্যস্ত করতে পারে। কিংবা অন্য কিছু ব্যাপার আছে কিনা তা আমরা তদন্ত করছি। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সে আত্মহত্যা করেছে। তাই আমরা ভিসেরা রিপোর্টের অপেক্ষায় আছি। সেখানে কী কী তথ্য পাওয়া যায় দেখা যাক।’ মালদ্বীপের পুলিশ তথ্য সংগ্রহ করছে বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ, ১৯৯৬ সালে ১৮ মে জন্ম মালদ্বীপের মেয়ে রাউধা আথিফের। গত বুধবার (২৯ মার্চ) দুপুরে রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রী হোস্টেলের ২০৯ নম্বর কক্ষ থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশ উদ্ধারের পর পুলিশকে জানানো হয়েছিল রাউধা সিলিং ফ্যানের সঙ্গে কাপড় বেঁধে গলায় ফাঁস দিয়ে রাউধা আত্মহত্যা করেছেন। তবে পুলিশ পৌঁছার আগেই তার সহপাঠীরা রাউধার লাশ নামিয়ে ফেলেছিলেন।
বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) রাউধার লাশ দেখতে রাজশাহীতে আসেন মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূত আয়েশাথ শান শাকির এবং তার মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা। শুক্রবার (৩১ মার্চ) মেডিক্যাল বোর্ড গঠনের মাধ্যমে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। রাউধা আত্মহত্যা করেছেন উল্লেখ করে বোর্ড শনিবার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। ওইদিন দুপুরে রাজশাহীর হেতেম খাঁ কবরস্থানে রাউধার দাফন সম্পন্ন হয়। রাউধার আত্মহত্যার বিষয়ে শাহ মখদুম থানায় করা অপমৃত্যুর মামলাটি গত রবিবার (০২ এপ্রিল) নগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
রাউধা রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। তিনি পড়ালেখার পাশাপাশি মডেলিং করতেন। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে বিশ্বখ্যাত ‘ভোগ’ ম্যাগাজিনের ভারতীয় সংস্করণে মডেল হয়েছিলেন। বাংলাট্রিবিউন
Check Also
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করেননি সমাজী
জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে আন্তর্জাতিক …