জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার। বাংলাদেশ সরকার চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ব্যক্তিবিশেষকে এবং শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৭৫ সাল থেকে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ একটি বড় উৎসব, যা বর্ণাঢ্য কর্মসূচি নৃত্য ও সংগীতের মাধ্যমে প্রতি বছর আয়োজন করা হয়।
অনেকগুলো ছবি যাচাই-বাছাইয়ের পর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের চন্য চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব থাকে জুরিবোর্ডে। এই জুরিবোর্ডের অন্যতম একজন সদস্য হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক ড. শফিউল আলম ভূঁইয়া। যিনি বিগত কয়েক বছর ধরে জুরিবোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
জানিয়ে রাখা ভালো, অধ্যাপক ড. শফিউল আলম ভূঁইয়া একাধারে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং টেলিভিশন ও ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে ড. শফিউল আলম ভূঁইয়া কীভাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেয়া হয় সেটা জানিয়েছেন।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নির্বাচন প্রক্রিয়া
প্রথমে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সাবমিশন চাওয়া হয়। প্রত্যেক চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রযোজক তাদের ছবির নামগুলো জমা দেন। সেখানে ছবির নামসহ অভিনয় শিল্পী, কলাকুশলীর নাম জমা দেয়া হয়। এরপর জুরিবোর্ডের সব মেম্বার বিজ্ঞাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এরপর যে ছবিগুলো জাতীয় চলচ্চিত্রের জন্য জমা দেয়া হয় সেগুলো আমরা একটি একটি করে দেখি। যে ছবিটি শ্রেষ্ঠ নির্বাচন করা হয়, সেটির সবকিছু বিবেচনায় রাখি। অভিনয়, শিল্পী, চিত্রগ্রাফি, মিউজিক, সম্পাদনা সবকিছুই বিবেচনা করা হয়। এগুলোর জন্যও আলাদা পুরস্কার থাকে।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কেন দেয়া হয়
পুরস্কার দেয়া হয় তুলনামূলক বিচারের ভিত্তিতে। যে ছবিগুলো জমা পড়ে সেগুলোর মধ্যেই প্রতিযোগিতা হয়। সরকার এ পুরস্কারটি দেয় চলচ্চিত্র শিল্পীকে উৎসাহিত করার জন্য। মানুষের আকর্ষণ, মনোযোগ এদিকে আনার জন্য দেয়া হয়। পাশাপাশি শিল্পী, কলাকুশলী যারা কাজ করেন তাদের উৎসাহিত করা। টাকার অংকে হিসাব করতে গেলে এটি কিন্তু খুব বেশি নয়। কিন্তু এটি বিরাট বড় সম্মান। জাতীয় পর্যায়ের সম্মান। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এটি রয়েছে।
এতগুলো ছবির তুলনামূলক বিচার কীভাবে করা হয়
সর্বশেষ ২০১৫ সালে যেসব ছবি নির্মিত হয়েছিল এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে যেসব ছবি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য জমা পড়েছিল এই ছবিগুলোর মধ্যে তুলনামূলক বিচার করা হয়। এই বিচার প্রক্রিয়ার দায়িত্বে থাকে জুরিবোর্ডের সদস্যরা। নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা নেই জুরিবোর্ডে। একেক বছর একেক রকম থাকে। তবে সংখ্যাটা এমন ১১ থেকে ১৩ আবার ১৯ জনও হয়ে থাকে। এসব সদস্য মিলে ছবি দেখি। আমাদের নম্বর দেয়ার জন্য আলাদা শিট আছে। প্রতিটি ক্যাটাগরিতে প্রত্যেক জুরিবোর্ডের মেম্বার আলাদাভাবে নম্বর দিয়ে থাকেন। সেই নম্বরগুলোকে গড় করে একটি সিদ্ধান্তে আসা হয়।
জুরি বোর্ডে কারা
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একাডেমিক হিসেবে আমি আছি। অন্যান্য সদস্যের মধ্যে একজন গুণী নির্মাতা থাকেন, প্রযোজক, শিল্পী, এডিটর, চিত্রগ্রাহক, ডান্স ডিরেক্টর প্রতিটি ক্যাটাগরির জন্য একজন করে থাকেন। বিশেষায়িত পুরস্কার দেয়ার সময় আমরা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছি। অনেক সময় পুরস্কার দেয়ার সময় এদিক-সেদিক হয়। এবার সেটা হয়নি। দেখা যায় আমি একজনকে দশের মধ্যে আট দিয়েছি, অন্যজন তাকে দশের মধ্যে দুই দিয়েছেন। এবার সেটা হয়নি। আমাদের জুরিবোর্ডের সবার বোঝাপড়া ভালো ছিল বিধায় এবার বেশি গড়মিল হয়নি। আর যদি কেউ খুব কম পায় তবে সেটা আমরা বিশেষভাবে বিবেচনা করি। এবার প্রতিযোগিতা খুব ভালো হয়েছে। যদি কেউ ক্যাটাগরিতে পাঁচ নিচে নম্বর পায় সেটা আমরা বিবেচনায় নেই না।
এরপর…
আমরা জুরিবোর্ডে থেকে সবকিছু বিবেচনা করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের একটা প্রস্তাবনা আমাদের জুরি বোর্ডের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে পাঠাই। আমরা জুরিবোর্ডের নিয়ম মেনে দুটি প্রস্তাবনা পাঠাই। সেটি হচ্ছে, ইনি যদি না পান, তাহলে উনি পাবেন। যেটাকে বলে বিকল্প ব্যবস্থা। তবে মন্ত্রণালয়ের কিন্তু অনেক ক্ষমতা রয়েছে। তারা আমাদের প্রস্তাবনা থেকে নিতে পারেন আবার নিজেরা ছবি দেখে দিতে পারেন। সবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা আসে মন্ত্রিপরিষদ থেকে।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে কী থাকে
পুরস্কার হিসেবে আঠার ক্যারেট মানের পনের গ্রাম স্বর্ণের একটি পদক, পদকের একটি রেপ্লিকা, একটি সম্মাননাপত্র দেয়া হয়। আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্তকে এক লাখ টাকা দেয়া হয়। শ্রেষ্ঠ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রযোজক ও শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রযোজককে ৫০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়।
এছাড়া শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রযোজক, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালককে ৫০ হাজার টাকা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ৩০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়।
এবার ২৫টি ক্যাটাগরিতে ৩১ জন শিল্পী ও কলাকুশলীকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৫ দেয়া হয়েছে। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানটি হয় গত ২৪ জুলাই।