সংক্ষুব্ধ পক্ষ রিভিউ করতে পারে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ‘আপত্তিকর’ বলে কিছু নেই, এক্সপাঞ্জ আবেদনেরও কোনো সুযোগ নেই

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ‘আপত্তিকর’  বলে কিছু নেই, এক্সপাঞ্জ আবেদনেরও কোনো সুযোগ নেই

নাজমুল আহসান রাজু : ষোড়শ সংশোধনীর আপিলের রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ “বক্তব্য আপত্তিকর” বলে মন্তব্য করা হয়েছে সরকারের মন্ত্রীসভায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এ ‘আপত্তিকর’ বক্তব্য প্রত্যাহারে প্রধান বিচারপতি বরাবর এক্সপাঞ্জ আপিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ব্যাপারে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় বাস্তবসম্মত। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে আপত্তিকর বলে কিছু থাকতে পারে না। সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় চূড়ান্ত এবং শেষ কথা। আপিলের রায় মানতে সকলে বাধ্য। রায়ের ব্যাপারে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) করতে পারেন। রিভিউর বাইরে প্রধান বিচারপতি বরাবারে এক্সপাঞ্জ পিটিশন করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আপিল খারিজ হয়েছে।

সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- সংসদের যে কোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে এবং আপীল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত যে কোনো বিধি-সাপেক্ষে আপীল বিভাগের কোনো ঘোষিত রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকিবে। নিয়ম অনুযায়ী আপিলের রায় প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করতে হয়। গত ১ আগষ্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের বিরুদ্ধে করা সরকারের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে। সে অনুযায়ী চলতি মাসের মধ্যে সরকারকে আপিল করতে হবে।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের চার বারের নির্বাচিত সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায় বাস্তবসম্মত রায়। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে কোনো আপত্তিকর বলে কিছু থাকে না, থাকতে পারে না। আদালতের পর্যবেক্ষণে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। এখন সংক্ষুব্ধপক্ষ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করতে পারে। সাধারণত রিভিউতে রায় পরিবর্তনের নজীর বিরল ঘটনা। আমি মনে করি রিভিউ করে কোনো লাভ হবে না।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ, কলামিস্ট ও সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমেদ বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখেছেন। রায়ে অনেকগুলো পর্যবেক্ষণ রয়েছে। এই পর্যবেক্ষণ অনুসরণযোগ্য। এই অবস্থায় কেউ সংক্ষুব্ধ হলে রায়ের রিভিউ চাইতে পারেন। এ জন্য রিভিউ আবেদন করতে হবে। রিভিউ না করে আবেদন করা যায়না।

প্রসঙ্গত গত সোমবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রীসভার বৈঠকের অনির্ধারিত আলোচনায় ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে দেয়া ‘আপত্তিকর’ বক্তব্য প্রত্যাহার করতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতি বরাবর লিখিত আবেদন করার সিদ্ধান্ত হয়। অনির্ধারিত আলোচনায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের কপি উত্থাপন করেন। তিনি রায়ের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে মন্ত্রিসভাকে অবহিত করেন। আইনমন্ত্রী বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে অপ্রাসঙ্গিক অনেক কিছু আনা হয়েছে, যা প্রয়োজন ছিল না। যেমন এখানে পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংশোধনী টেনে আনা হয়েছে। এ রায়ে সংসদকে ‘ইমম্যাচিউরড’ (অপরিপক্ক) বলা হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও এ রায়ে আরও অনেক ‘আপত্তিকর’ বিষয় রয়েছে বলে আইনমন্ত্রী মন্ত্রিসভাকে অবহিত করেন।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রায়তো ওনারা দিয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি আপনাদের হাতে এসেছে। এখন রায়ের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ নিয়ে কথা বলুন। এ বিষয়ে জনমত গড়ে তুলুন। জনগণ যেন বুঝতে পারে ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়ে তারা (আদালতের বিচারক) কী মন্তব্য করেছেন। তিনি আরও বলেন, রায়ে কোথাও কোথাও সরকার ও জনগণ সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছে। কাজেই আপনারা যেখানেই সুযোগ পাবেন সেখানেই জনগণকে এসব বিষয় জানাবেন। তিনি বলেন, আগে রায় সম্পর্কে জেনেছিলাম। এখন রায়ের কপি হাতে পেয়ে পড়ে দেখলাম, বুঝলাম। জনগণকে এসব বিষয় জানাবেন, কারণ আমরা জনগণের প্রতিনিধি। জনগণের এসব বিষয় জানার অধিকার আছে।

প্রসঙ্গত গত ১ আগস্ট বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। রায়ে বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা বর্তমান সংসদ অপরিপক্ক, নির্বাচন কমিশন, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ , এক এগারো নিয়ে পর্যবেক্ষণ দেন। প্রধান বিচারপতি রায়ে উল্লেখ করেন, ষোড়শ সংশোধনী মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের রায় প্রদানের পরে সুপ্রিম কোর্ট লক্ষ্য করেছেন যে সংসদ সদস্যরা রায়ের সমালোচনা করে সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন। রায় এবং বিচারকদের শুদ্ধতা নিয়ে অসংসদীয় ভাষায় প্রশ্ন তুলেছেন। এটা প্রমাণ করে যে আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র অপরিপক্ক।’ ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি রায়ে বলেন, ‘এই অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের বেদনাহত এবং অসংগতভাবে তাদের অধিকারকে শৃঙ্খলিত করেছে।’ নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে তিনি অভিযোগ করেন এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিকরণ হয়নি।

Check Also

ট্রাইব্যুনালে আ.লীগ নেতাদের বিচার দেখতে এসে যা বললেন সাঈদী পুত্র

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।