১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সামরিক-বেসামরিক পাল্টা আঘাতের শঙ্কায় ছিল খুনিরা। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে প্রতি আক্রমণ মোকাবিলার জন্য তারা প্রায় ঘণ্টা চারেক প্রস্তুতি নিয়ে বসেছিল।
কিন্তু চার ঘণ্টা কেন, সারা দিন পেরিয়ে গেলেও ধানমন্ডি বা ঢাকায় গড়ে ওঠেনি কোনো প্রতিরোধ। রাজপথেও দেখা যায়নি ‘বঙ্গবন্ধুর লোক’ হিসেবে পরিচিত তৎকালীন জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) নেতা ও বিভিন্ন সরকারি উচ্চ পদে দায়িত্বশীলদের। বরং খুনিদের নতুন সরকারে যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কিছু নেতা ও সরকারি কর্মকর্তা। পেয়েছেন আগের চেয়ে বড় পদ ও সুযোগ-সুবিধা। জানা যায়, জাতির জনককে হত্যার আগে টানা তিন দিন গভীর রাতে কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে (বার্ড) জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসআই) প্রধান এ বি এস সফদারের সঙ্গে বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও সরকারি আমলা মাহবুব আলম চাষী। এই কয়েক দিন তাদের দেখা যায়নি প্রকাশ্যে। কিন্তু ১৫ আগস্টে এই তিনজনকে ঢাকায় হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় দেখা যায়। খন্দকার মোশতাক বসে যান রাষ্ট্রপতির আসনে। ডাকেন মন্ত্রিসভার বৈঠক। পরবর্তীতে জেলখানায় নিহত জাতীয় চার নেতা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার প্রায় সবাই সেদিন উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে। অবশ্য জোর করেও উপস্থিত করা হয়েছে কাউকে কাউকে। যেমন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার প্রবীণ সদস্য ফণী ভূষণ মজুমদারকে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থা থেকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয়েছে বঙ্গভবনে। মন্ত্রীদের নিয়ে সেদিন কী ধরনের আলোচনা খন্দকার মোশতাক করেছিলেন, তার তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এটা ঠিক, সেদিন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি কথাও হয়নি মন্ত্রিসভায়। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীরা জাতির জনক হত্যাকাণ্ড নিয়ে জানতেও চাননি। যতদূর জানা গেছে, খন্দকার মোশতাক সেই বৈঠকে বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক কী হতে পারে তা নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন উপস্থিত মন্ত্রীদের কাছ থেকে। ১৯৭৫-এর জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের সিদ্ধান্ত নিলে এর তীব্র প্রতিবাদ জানান মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন করা জেনারেল এম এ জি ওসমানী। প্রতিবাদে জাতীয় সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। কিন্তু সেই ওসমানীই আবার মোশতাকের নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন। মোশতাক সরকারের পুরোটা সময়ই তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে ৮ আগস্ট বঙ্গবন্ধু তার মন্ত্রিসভায় স্থান দেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে। তাকে এর আগে রাষ্ট্রপতিও বানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই আবু সাঈদ চৌধুরীই মোশতাক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ১৫ আগস্টের আগে সরকারি কাজে বিদেশ সফরে ছিলেন। জাতির জনককে হত্যার খবর পাওয়ার পর তিনি দেশে আসতে অস্বীকৃতি জানান। অভিযোগ আছে, বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যার একজন তখন ড. কামাল হোসেনকে লন্ডনে মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করতে বললেও তখন তা করেননি ড. কামাল। মুুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রথম ডেপুটি স্পিকার ও পরে স্পিকার নির্বাচিত হওয়া আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদউল্লাহকে ১৯৭৩ সালে প্রথম রাষ্ট্রপতিও করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরে ১৯৭৫-এর শুরুর দিকে মোহাম্মদউল্লাহকে মন্ত্রী হিসেবে নিজের মন্ত্রিসভায় স্থান দেন বঙ্গবন্ধু। সেই মোহাম্মদউল্লাহ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরপরই খন্দকার মোশতাকের সরকারে যোগ দেন। ছিলেন মন্ত্রী জিয়ার সরকারেও। এমনকি জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর সাত্তার সরকারের একদিনের উপ-রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও পালন করেন মোহাম্মদউল্লাহ। একাত্তরে মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্র পাঠ করা অধ্যাপক ইউসুফ আলী বঙ্গবন্ধু সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। ১৫ আগস্টের পর তিনিই আবার খুশি মনে যোগ দিয়েছেন খুনি মোশতাকের সরকারে। ইউসুফ আলী পরে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। ছাত্রলীগ নেতা থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া কে এম ওবায়দুর রহমান দলীয় এমপি ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তিনি মোশতাক সরকারের ক্ষমতাধর মন্ত্রী হিসেবে দেখা দেন। মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রথম সংসদে আওয়ামী লীগের হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর একইভাবে বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদ পাওয়া সত্ত্বেও পল্টি দিয়েছেন রাতারাতি। অন্যদিকে খুনিরা ১৫ আগস্ট ভোরে ট্যাংক নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে আক্রমণ চালালে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহকে ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। প্রেসিডেন্টের বাসভবনে যাওয়ার জন্য আদেশ পান সেনাপ্রধান। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক ৩২ নম্বরে যাননি কে এম শফিউল্লাহ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাকের সরকারের প্রতি সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে আনুগত্য প্রকাশ করতে খুব একটা দেরি হয়নি কে এম শফিউল্লাহর। বিমানবাহিনী প্রধান এ কে খন্দকার ও নৌবাহিনী প্রধান এম এইচ খানকে নিয়ে প্রথম দিনেই মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন তিনি। পরে অবশ্য কয়েক দিনের মধ্যেই কে এম শফিউল্লাহ ও এ কে খন্দকারকে যথাক্রমে জিয়াউর রহমান ও এম জি তায়েবের কাছে সেনা ও বিমানবাহিনী প্রধানের পদ ছেড়ে দিতে হয়। এর কয়েক দিন পরই কে এম শফিউল্লাহ রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে চলে যান বিদেশে। জিয়া ও এরশাদ সরকারের পুরোটা সময় তিনি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। সেই কে এম শফিউল্লাহ পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ১৯৯৬ সালে এমপি নির্বাচিত হন। প্রায় একইভাবে এ কে খন্দকারও বিদেশে বাংলাদেশের মিশনে দায়িত্ব নেন। প্রথমে অস্ট্রেলিয়া ও পরে ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনের দায়িত্ব পালন করেন। ফিরে এসে এরশাদ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কিছু দিন কাজ করে দায়িত্ব নেন পরিকল্পনামন্ত্রীর। পরে বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রথম মেয়াদের সরকারে পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পান এ কে খন্দকার। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধে উপ-সর্বাধিনায়ক জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে নিজের বইতে বঙ্গবন্ধুর মুখে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বসাতে গিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে পরিবারসহ হত্যার পর ২৩ আগস্ট মোশতাক সরকার গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, শেখ আবদুল আজিজ, আবদুস সামাদ আজাদ, এম কোরবান আলী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, হাশেম উদ্দিন পাহাড়ীসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে। ৩ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গ্রেফতার অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব.) এম মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে। এর আগে ৬ সেপ্টেম্বর জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ এবং কয়েক দিনের ব্যবধানে আমির হোসেন আমু, গাজী গোলাম মোস্তফা, এম এ জলিল, এম এ মান্নান, সরদার আমজাদ হোসেন, নুরুল হক, এম শামসুদ্দোহা, এম মতিউর রহমানসহ বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার এড়াতে প্রতিবেশী ভারতে চলে যান আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, শেখ সেলিম, ওবায়দুল কাদের, ইসমত কাদির গামা, মো. নাসিম, মোস্তফা মহসিন মন্টু, শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, লতিফ সিদ্দিকী, পংকজ ভট্টাচার্য, ডা. এস এ মালেক, এস এম ইউসুফ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, খোকা রায়, রবিউল মুক্তাদিরসহ তৎকালীন বাকশাল ও বর্তমান আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী। তবে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বেশ কিছু অনুসারীসহ মেঘালয়ে আশ্রয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ ও খুনিদের বিতাড়িত করার জন্য প্রতিরোধের ডাক দেন। হত্যাকাণ্ডের প্রায় তিন বছর পর ১৯৭৮ সালের ৩-৫ মার্চ ঢাকায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে কারাগারে আটক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মুক্তি এবং ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড এবং জেল হত্যার বিচার দাবি করা হয়।bd.